অবিচার [ নবম পর্ব ]

অবিচার [নবম পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

ষষ্ঠ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

সপ্তম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

অষ্টম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

‘তুই প্রেম-টেম করিস না?’
লিজার এমন কথা শুনে শৈলী হতভম্ব হয়ে গেছে। কোনো কোচিং এ না পড়েও সে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে, ভালো রেজাল্ট করে এসেছে সবসময়,
আবৃত্তিতে, উপস্থিত বক্তৃতায় বরাবরই প্রথম ছিল। এ সব অর্জনই যেন ফিকে হয়ে গেছে লিজার এই একটা প্রশ্নে। প্রেম না করা কি আসলেই একটা ব্যর্থতা!

শৈলীর ফুফাতো বোন লিজা দুদিন আগে এসেছে তাদের বাসায়। ছোট্ট একটা বাসা। ড্রয়িংরুমে শিহাব থাকে। মাঝের ডাইনিং স্পেসের মতো জায়গাটায় থাকে শৈলী। মোমেনা ফুফু তার সাথেই থাকছে। এখন আবার লিজা। গাদাগাদি করে রাতটা কোনোভাবে কাটিয়ে দেয়া যায়। খুব কষ্টকর হয় যখন শৈলী পড়তে বসে। ঘড়ি ধরা পাঁচ মিনিট পরপর মোমেনা ফুফুর মোবাইলে কল আসে। কাদের সাথে ফুফু এত কথা বলে সেটা ভেবে কূল পায় না শৈলী!

আবার লিজারও কল আসে ফুফুর মোবাইলে। লিজা শুধু হিহি করে হাসে, আর হু হা করে জবাব দেয়। কথা বললে বেশির ভাগই বোঝা যায় না। অপর পাশের মানুষটা কি আসলেই কিছু শুনতেই পায়? শৈলী নিজের সাথে যুদ্ধ করে মনটাকে টেনে হিঁচড়ে এনে বইয়ের মধ্যে রাখে। কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ডেই উড়ে যায় ফুফু আর বাবার আলোচনায়, নাহলে লিজার অসংলগ্ন কথাবার্তায়।

এই যে এইমাত্র লিজা যে প্রশ্নটা করল, সেটা শুনেই এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে সে অনেক্ষণ কিছু বলতেই পারল না! এতক্ষণ যে বইটা পড়ছিল সেটা বন্ধ করে লিজার দিকে ফিরে তাকালো সে। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘প্রেম করাটা কি খুব জরুরি?’

এমন কিছু লিজা আশা করেনি। সে পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘নাহ্, জরুরি হবে কেন? আর তা ছাড়া তোর মতো মেয়েদের জন্য তো প্রেম করার কোনো দরকারই নাই।’

ভ্রু কুঁচকে রেখে শৈলী জানতে চাইল, ‘আমার মতো মেয়ে মানে! কী বলতে চাচ্ছিস তুই?’

লিজা এবার ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তুই একটা সুখী পরিবারে বেড়ে ওঠেছিস। কোনো টেনশন নাই, অশান্তি নাই! সারাদিন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকিস। ভালো রেজাল্ট করেছিস। সামনেও করবি। ভালো ঘরে বিয়ে হবে। প্রেম-টেম করার তো আসলেই দরকার নাই।’

লিজার এমন ব্যাখ্যা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না শৈলী। একবার নিজের পরনের জামা আর লিজার পরনের জামার দিকে তাকায় সে। লিজা পরেছে পাকিস্তানি লোন। এই কাপড় কিনবে কিনবে করে কেনা হচ্ছে না তার। হাজার বারোশ দাম হয়। শৈলী সারা জীবন পরে এসেছে থান কাপড়। ষাট-সত্তর টাকা গজ। মিল রেখে ওড়না আর সালোয়ারের কাপড় কিনতে হয়। সব মিলে পাঁচ-ছয়শতে হয়ে যায়। পাকিস্তানি লোন কেনার সাহস হয়ে ওঠে না।

লিজা মাছ-মাংস ছাড়া খেতে পারে না। আর শৈলীদের মাসে একবার মাছ-মাংস খাওয়া হয়। খাওয়া-পরা বাদ দিলেও ঘরের নিত্য অশান্তির কথা ভোলা যায় না। এমন একটা দিন নেই যেদিন মফিজ চিল্লাচিল্লি করেন না। তরকারিতে লবণ হয়নি, অথবা বেশি হয়েছে কেন? চোখের পলক পড়ার আগেই বাঁ হাতে আছিয়া খাতুনকে চড় দিয়েছেন। চাল কুমড়াতে মশুর ডাল দাওনি কেন, তরকারির হাঁড়িটাই ছুড়ে মেরেছেন। শিহাব পান এনেছে, দুটো পান হলদে কেন? শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছেন। শিহাবকে সেই পান আবার বদলে আনতে হয়েছে। আরও কত কী…! অথচ লিজা বলছে এটা সুখী পরিবার!

সুখের সংজ্ঞা কি একেক জনের কাছে একেক রকম? লিজার বাবা-মায়ের মধ্যে মিল নেই, শুধু এই একটা কারণেই কি তাদের পরিবারকে অসুখী বলা যাবে? আর শৈলীদের চার সদস্যের পরিবারকে সুখী বলা যাবে, তার বাবার মুখোশধারী চাল-চলনের কারণে? শৈলী বহুবার দেখেছে, শুনেছে, বাইরের মানুষজন যারা তাদের ভেতরের অবস্থা জানে না, তারা বলাবলি করে- ‘মফিজ সাহেবের কী চমৎকার ফ্যামিলি মাশা-আল্লাহ!’ অথচ এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যই নিজ নিজ জায়গা থেকে অসুখী।

এত সব কথা না বলে শৈলী লিজাকে অন্যভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘অশান্তি সব ঘরেই থাকে রে। তাই বলে কি প্রেম করতে হবে? ভালো রেজাল্ট করে চাকরি বাকরি করলে দেখবি এই দিনগুলোর কথা মনেই থাকবে না।’

লিজা ঠোঁট উল্টে বলে, ‘ভালো রেজাল্ট করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু ভালো স্বামী পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। জামাই ভালো না হলে আজীবন কষ্ট পেতে হবে। সেজন্য নিজে দেখে শুনে পরখ করে বিয়ে করাই ভালো। বাপ-মা ধরে বেঁধে বিয়ে দিলে যদি সেই ছেলে ভালো না হয়! প্রেম করে বিয়ে করলে অন্তত বাপ-মাকে দোষ দিতে হবে না। এজন্যই প্রেম করে বিয়ে করা উচিত। আমি তো বলব তুইও একটা ভালো ছেলে দেখে প্রেম-টেম শুরু করে দে!’

লিজার কথা শুনে শৈলী চিন্তায় পড়ে যায়। আসলেই তো। সে নিজেই তো সবসময় নানুভাই আর নানুমনিকে দোষারোপ করে এসেছে, তার বাবার সাথেই কেন তার মাকে বিয়ে দিয়েছেন তারা। তাদের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই তার মাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে এখন। তাহলে কি লিজার কথায় ঠিক? প্রেম করে বিয়ে করাটাই কি উচিত কাজ হবে?

প্রেম করার ব্যাপারে শৈলীর মন আগে কখনো সায় দেয়নি। কত ছেলে তাকে চিঠি দিয়েছে, কলেজ থেকে ফেরার পথে পিছু নিয়েছে, সামনে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলেছে। সবাইকে এড়িয়ে গেছে সে। ইদানীং কেউ একজন নিয়মিত তাকে ফোন করে। কথা বলে না। শুধু গান শোনায়। প্রথম প্রথম শৈলী শুনত না। ফোন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখত। কিন্তু গত দুয়েকদিন ধরে সে গানগুলো শোনে। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা পর্যন্তও গান চলে অপর পাশে।

শৈলী কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনে আর হিসাব বিজ্ঞানের জটিল অংক মেলায়। এই তো গতকালও কী সুন্দর একটা গান শুনেছিল, যেটা আগে কখনো শোনা হয়নি। ‘তুমি দূরে দূরে আর থেকো না…’ গানের কথাগুলো সব মনে নেই। ওই লাইনটাই শুধু মনে আছে। গানটার কথা মনে পড়তেই মুখে লজ্জার রক্তিম আভা ফুটে ওঠে শৈলীর। লিজা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য প্রসঙ্গ পাল্টানোর ফিকির খুঁজতে থাকে সে।

ঠিক তখনই মোমেনা আর মফিজ হাস্যোজ্বল মুখে ঘরে প্রবেশ করে। দুই ভাই-বোনকে দেখে মনে হয় কোনো রাজ্য জয় করেছে ফিরেছে তারা। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ভাই-বোন আলোচনায় বসে। খাতা কলম নিয়ে শৈলীকেও বসতে হয়। লিজা মাথাব্যথার অযুহাতে পার পেয়ে যায়। আসলে সে কিন্তু ফোনে তুহিনের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত।

মফিজ আর মোমেনা দীর্ঘ সময় শলা পরামর্শ করে যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে সেগুলোই শৈলী খাতায় লিখে নিচ্ছে। একদম প্রথমে লিখেছে, বাদল মোমেনার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলবে না, গালিগালাজ করবে না, গায়ে হাতও তুলবে না। শৈলী লিখে নেওয়া মাত্রই মোমেনা জিজ্ঞেস করেছে, ‘তারপরও যদি মারে? কেউ তো আর দেখতেসে না। যদি মারার পর স্বীকার না যায় যে মারসে? আমার কথা পুলিশে বিশ্বাস নাও করতে পারে।’

মফিজ নড়েচড়ে বসল। আসলেই তো। এত লেখাজোখা করে লাভ কী? বাদল যদি এসবের কিছুই না মানে! সে যদি মোমেনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করে! সেটার তো কোনো সাক্ষীও থাকবে না। তাছাড়া আজকের বৈঠকে বাদলের সাথে এসআই জলিলের সুসম্পর্কের ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। একটু ভেবে নিয়ে মফিজ বলে, ‘তো কী হইসে? তোরে যদি একটা থাপ্পড় মারে তুই দশটা থাপ্পড় মারবি। যদি একটা গালি দেই তুই দশটা গালি দিবি। বুঝছস?’

মোমেনা হাসিমুখে মাথা নাড়ে। যেন ভাইয়ের এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল সে। এখন অনুমতি পেয়ে যারপরনাই খুশি। আর এই কথাটাই শুনে শৈলী থ বনে গেছে। ভাই তার বোনকে স্বামীকে মারার মতো উপদেশ দেয়, এটা বোধহয় শুধু মফিজের পক্ষেই সম্ভব! শৈলী মনে মনে ভাবে, এই কথাটা যদি আর কেউ শুনত, তাহলে এটা ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেত। সাথে সাথে মাওলানা মফিজুর রহমান আনসারীর নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হতো। আচ্ছা, ভালো মানুষের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হলে, খারাপ মানুষের নাম কী দিয়ে লেখা হতে পারে? এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না তার!

শৈলী এইসব হাবিজাবি ভাবনা বেশিক্ষণ ভাবতে পারেনি। মফিজের ষাঁড়ের মতো আওয়াজে ধমক খেয়ে আবার লিখতে শুরু করে। লিখতে লিখতে খাতার পাতা ভরে যায়, কিন্তু এই দুই ভাই-বোনের মন কিছুতেই ভরে না। শৈলী ঘুমে ঢুলতে থাকে। অনেক রাতে সে ছুটি পায়। ওরা ভাইবোন তখনো বৈঠক ভাঙেনি। কত পরিকল্পনা বাকি আছে কে জানে! সব কি একরাতেই করে ফেলবে!

যাক, শৈলী অন্তত ঘুমাতে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে এই ঢের। রুম থেকে বেরোনোর সময় সে আড়চোখে মায়ের দিকে তাকায়। আছিয়া খাতুন মটকা মেরে বিছানায় শুয়ে আছেন। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অথচ, শৈলী জানে, মা ঘুমাচ্ছে না! মফিজ আর মোমেনার উঁচু গলার কথোপকথনে ঘুম আসা অসম্ভব ব্যাপার।

রাতে ঘুম না হলেও আছিয়া খাতুনকে ভোরে সবার আগে উঠতে হবে। এতগুলো মানুষের জন্য নাশতা বানাতে হবে। সব তিনি একাই করেন। এরমধ্যে একটু হেরফের হলে মোমেনার টিপ্পনি, লিজার গাল ফুলিয়ে অভিমান আর মফিজের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল তো আছেই। ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা মাকে দেখে শৈলীর অবাক হওয়ার মতো শক্তিও অবশিষ্ট নেই আর। রুমে যেতে যেতে সে ভাবে, ‘এই মহিলা কেন এই সংসারে এত বছর ধরে পড়ে আছে! কীভাবে আছে!’

বিছানায় শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই ঝপ করে ঘুমের চাদর নেমে আসে চোখের পাতায়। কিন্তু সাথে সাথেই ঘুম ভেঙে যায় কারও খিলখিল করে হাসির শব্দে। আবছা আলোয় শৈলী দেখতে পায়, লিজা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মেঝেতে পা বিছিয়ে, আয়েশ করে কথা বলছে। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হতে থাকে শৈলীর। রাগ করে বলে, ‘এত রাতেও কথা বলতে হবে তোর? আমি ঘুমাতে পারতেছি না। প্লিজ কথা বন্ধ কর।’

‘তোমাকে এক মিনিট পর ফোন দিচ্ছি’ বলে ফোন কেটে দেয় লিজা। তারপর শৈলীর কাছে এসে বলে, ‘মামা কিন্তু আমার কথাটা জানে। মামা বলেছে পালিয়ে বিয়ে করতে। সেজন্য তুহিনকে রাজি করাতে হবে না? তুই যদি তেড়িবেড়ি করিস তাহলে এখনই মামাকে গিয়ে বলে দেবো যে, তুই আমাকে ডিস্টার্ব করতিছিস।’

কথাগুলো বলেই লিজা আবারও আগের মতোই আরাম করে বসল। তারপর আবারও ফোনে কথা বলা শুরু করল। প্রচণ্ড রাগে শৈলীর কান্না চলে আসে। মাথার ওপর বালিশ চেপে ধরে শুয়ে পরে সে! চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। ঠিক তখনই টুং শব্দ করে তার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে, ‘খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ঘুমের পরি কি নেমে এসেছে, আমার দেখা পরিটার চোখের পাতায়? মানবরূপী সেই পরিটার নাম শৈলী…
এই নিস্তব্দ রাতে প্রিয় গানগুলো শুনছিলাম। যদি এখনো সে জেগে থাকে তবে তাকেও শোনাতাম।’

অবিশ্বাস্য চোখে শৈলী মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাথে সাথেই কল এসেছে সেই নাম্বার থেকে। আড়চোখে একবার লিজার দিকে তাকিয়ে সে রিসিভ করে। কানে হেডফোন লাগানো আছে। অপরপাশ থেকে গান ভেসে আসছে,

‘এই রাত তোমার আমার,
এই চাঁদ তোমার আমার,
শুধু দুজনের…’

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ নবম পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ নবম পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ নবম পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [ নবম পর্ব ]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [ নবম পর্ব ]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: