অবিচার [ পঞ্চম পর্ব ]

অবিচার [পঞ্চম পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

আজকে কম্পিউটার শিক্ষা বিষয়ে পরীক্ষা ছিল শৈলীর। খুব একটা ভালো হয়নি। পাশ করতে পারলেই যথেষ্ট হবে। কাল রাতে কিছুই পড়তে পারেনি সে। মনোযোগ ছিল না একটুও। আগে যা পড়া ছিল সেটুকু রিভিশন দিতে বই নিয়ে বসেছিল। কিন্তু মনোযোগ বারবার চলে যাচ্ছিল বাবা আর ফুফুর আলোচনায়।

পরীক্ষার হলে সব প্রশ্নের উত্তর মাঝখানে এসে ভুলে যাচ্ছিল সে। কিছুতেই মনে পড়ছিল না। কেন যেন ফুফুকে বলা বাবার ওই কথাটায় বারবার মনে আসছিল, ‘লিজাকে বল তুহিনকে নিয়া পালাইয়া যাইতে। একেবারে বিয়া করে ফেলতে বল।’

ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে শৈলীর। কোনো মামা কি তার ভাগ্নির জন্য এমন পরামর্শ দিতে পারে! আর তা ছাড়া তার বাবা একজন মসজিদের ইমাম। তার পেছনে কতশত মানুষ নামাজ পড়ে। যারা তার পেছনে নামাজে দাঁড়ায়, তারা কি জানে যে- একজন মুমিন, আল্লাহ ভীরু আলেমের পেছনে নামাজ পড়ছে না, একটা শয়তানের পেছনে দাঁড়িয়েছে তারা! শৈলীর প্রচণ্ড ঘৃণাবোধ হতে থাকে।

এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার শৈলীর মোবাইলে কল আসে। একটা অচেনা নম্বর থেকে। মাসখানেক ধরে অনেকগুলো অচেনা নম্বর তাকে বিরক্ত করছে। সে এই ধরনের ফোন রিসিভ করে না। এমনি মোবাইল সাইলেন্ট করে ফেলে রাখে। একদিন তার বান্ধবী মীনা ফোন করে বলেছিল, ‘কীরে তুই ফোন রিসিভ করিস না কেন? তৌহিদ স্যার নাকি তোকে ফোনে পাচ্ছে না? আমাকে ফোন করে বকাঝকা করছে। তুই স্যারের ফোন রিসিভ কর তো।’

সেদিন শৈলীরও অনেক কথা শুনতে হয়েছিল। স্যার খুব বকেছিলেন প্রথমে। তারপর বলেছিলেন, ‘আননোন নাম্বার হলেই ফোন রিসিভ না করাটা যৌক্তিক হতে পারে না। অচেনা নাম্বার থেকে কোনো জরুরি ফোনও তো আসতে পারে। যদি রিসিভ করে দেখো, কেউ শুধুই বিরক্ত করার জন্য ফোন করেছে, তাহলে কেটে দিলেই তো হয়।’

সেই থেকে অচেনা নম্বর হলেও শৈলীকে বাধ্য হয়ে ফোন ধরতে হয়। কিন্তু আজ সে পরীক্ষার হলে ছিল। ফোন রিসিভ করা সম্ভব হয়নি। তাই এখন নিজেই সে নম্বরে কলব্যাক করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ওপাশ থেকে কেটে দেয়। কেটে দিয়ে ওপাশ থেকে আবার কল করে। শৈলী ভ্রু কুঁচকে ফেলে, ভাবে, এত দরদি মানুষ কে হতে পারে! কিছুটা দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করতেই শুনতে পায় তপুর কণ্ঠে গান, ‘সোনার মেয়ে তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি। তোমায় দিলাম মধ্যদিনের টিনের চালের বৃষ্টি রাশি, মুখে বললাম না, বললাম নারে ভালোবাসি।’

অন্য সময় হলে শৈলী বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিত। কিন্তু আজ কী যে হলো, কেন যেন রেখে দিতে ইচ্ছেই হলো না। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গানটা শুনতে লাগল সে। আপনা-আপনি চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে তার। নিজের অজান্তেই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে তাকে দেখে আরেকবার প্রেমে পড়ে ছেলেটা। যার কথা শৈলীর এখনো অজানা।

বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল পাঁচটা বেজে যায় শৈলীর। ঢুকেই দেখতে পায়, এলাহি আয়োজন চলছে। মোমেনা ফুফু বেশ বড়সড় একটা মুরগি নিয়ে বসেছেন। শৈলীর মা প্রায় এক হাত লম্বা পেটমোটা একটা মাছ কাটতে ব্যস্ত। ঘটনা কী! শৈলী মনে মনে বলল, বোধহয় ফুফা আসবে ফুফুকে নিতে।

শৈলীর বড় ভাই শিহাব বাসা থেকে বের হচ্ছিল, তখন সে বলল, ‘ভাইয়া দেখছ কাণ্ডটা? প্রতিবার জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করে চলে আসবে। তারপর ফুফা আসবে তাকে নিতে। আর এতসব আয়োজনে আমাদের কত্ত টাকা খরচ হয়ে যায়। নিশ্চয় আম্মু তোমার টিউশনির টাকা খরচ করে ফেলছে, না? আমি বলছিলাম সেকেন্ড ইয়ারের বই কিনতে হবে, যেন কিছু টাকা আলাদা করে রাখে। এখন আমার বইয়ের কী হবে?’

শৈলী কেঁদে ফেলছে প্রায়, শিহাব তাড়াতাড়ি বলল, ‘আরে না না, আম্মু কোনো টাকা দেয় নাই পাগলি। আব্বুই হাতভর্তি বাজার নিয়ে আসছে। আর হ্যাঁ, উনি আজকে আর মসজিদে যাবে না।’ শৈলী চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ওমা! সূর্য আজকে কোনদিকে উঠছে ভাইয়া?’ শিহাব ফিসফিস করে বলে, ‘আর, ফুফা না, ওই লম্পট, ক্যারেক্টারলেস তাহের নূরী আসবে। আব্বুই দাওয়াত দিছে। শোন, আমি আসার আগ পর্যন্ত তুই একটু সামলে নিস সব।’

শৈলী এবার আঁতকে উঠে। এই তাহের নূরীকে বাবা বিশেষ সমাদর করে। কিন্তু লোকটাকে তারা ভাইবোন ও তাদের মা কেউই পছন্দ করে না। লোকটার হাবভাব খুবই খারাপ। শিহাব তো লম্পট আর ক্যারেক্টারলেস ছাড়া কথায়ই বলে না।

আজ রাতে সেই লোকটাকে বাসায় দাওয়াত দিয়েছে মফিজ। তার মানে কোনো বিশেষ কারণ তো আছেই! শৈলী ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। একদিকে মোমেনা ফুফুর আগমন অন্যদিকে তাহের নূরী।

যখনই খারাপ কিছু ঘটতে যায়, শৈলী আগে থেকেই যেন ঠের পায়। বুকের ভেতর কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে, গলা শুকিয়ে আসে, দু হাতের তালু ঘামতে থাকে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণেই বোধহয় এমন হয়। কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হতেও ভুলে যায় সে। স্থাণু হয়ে বসে থাকে।

মফিজ তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলে ওঠেন, ‘শৈল…এখনো জামা-কাপড় পাল্টাও নাই? যাও তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, তোমার আম্মু আর ফুফুকে হেল্প করো। তোমার তাহের আংকেল আসবে আজকে।’

‘উফ অসহ্য!’ এমনিতে পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। বাসায় ফিরে একটা শান্তির ঘুম দেবে ভেবেছিল শৈলী। সেটাও বন্ধ করে দিলেন মফিজ।

শৈলী মেঝের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবা নামের লোকটার দিকে তাকাতে পারে না সে। প্রচণ্ড অভিমান হয় তার। তিনি জানতেন আজকে শৈলীর পরীক্ষা ছিল। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না, পরীক্ষা কেমন হলো, সে কিছু খেয়েছে কি ন! কত দূরে কলেজ। দুটো বাস পাল্টাতে হয়। কোথায় নিজেই বলবেন, ‘একটু বিশ্রাম নাও!’ তা না, কাজ করার নির্দেশ দিচ্ছেন। অভিমানে শৈলীর চোখে পানি চলে আসে।

মেয়েদের জীবনের প্রথম নায়ক হয় তাদের বাবা। কিন্তু শৈলীর বাবা তার জন্য খলনায়ক। ‘বাবা’ শব্দটা জুড়ে যে প্রগাঢ় ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে সেটা শৈলীর কাছে কেবলই গল্পের মতো মনে হয়! বাবার আদর যেন অবাস্তব কিছু, যার অস্তিত্ব অন্তত তার কাছে নেই। নেই শিহাবের কাছেও। বাবা মানেই তাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক।

‘এই দিনগুলির শেষ কবে হবে আল্লাহ?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে শৈলী। বরাবরের মতো এবারও এই প্রশ্নের উত্তর সে পায় না!

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ পঞ্চম পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ পঞ্চম পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ পঞ্চম পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [পঞ্চম পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [পঞ্চম পর্ব]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: