অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতোই সহজ সরল ছিল রানুর জীবন। চঞ্চল, স্রোতস্বী নদীর মতন। নদীর বাঁকে বাঁকে সুখের ঘাট। হেসে খেলেই দিন কাটতো তার। এক সময় কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখল। শরীর জুড়ে অথৈ সাগর। যৌবনের ভরা জলে যে কেউ সাঁতার কাটতে চাইত। যেকোনো বয়সী পুরুষের মনে ঝড় তুলতে পারতো তার দেহ। তাকে দেখে চক্ষু ছানাবড়া হয়নি এমন পুরুষ খুব কমই আছে। কারণে অকারণে আমিও যে তার দিকে চোখ দিইনি তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না।

সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখা রানুর মন তখনো কিশোরীসুলভই রয়ে গেছে। তার উঠতি শরীরের রূপের আগুন যখন চারদিক জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে শত শত যুবকের শূন্য হৃদয়। এমন একটা সময়ে অভাগীর কপাল পুড়ল। হুট করেই তার মা চলে গেলেন ওপারে। যে পার থেকে কেউ কখনো ফিরে আসেনি। সেই থেকে শুরু রানুর জীবনের দুর্বিষহ অধ্যায়। বাবা আর একটা বিয়ে করল। তিন ভাই আছে যে যার মতো। তার দিকে কারও খেয়াল রাখত না। মা কে হারিয়ে তার পুরো পৃথিবী আধাঁরে ডুবে গেল। বাবা নতুন বউ নিয়ে বেশ আমোদে থাকতেন। ছেলে মেয়ের কথা তার মনেই পড়ত না। ভাইয়েরা হয়তো ভুলে গেছিল তাদের একটা বোন আছে।

⏩ আরও পড়ুন: সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, বাড়িওয়ালা ছিল আমার আম্মার খালুর বন্ধু। সেকারণে আম্মা উনাকে মামা ডাকতেন। রানু ছিল উনার আপন ভাগিনি। ছোটো বেলায় মামা বাড়িতে বেড়াতে আসলে দেখতাম রানুকে। আমার চোখের সামনেই যেন হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেল মেয়েটা। এইতো ক’দিন আগেই যেন হাটু পর্যন্ত ফ্রক পরে বেড়াতে আসলো। আর এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছে। ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ পরে। ওড়না দিয়ে মাথা আর বুক ঢাকে। ওর শরীরের গড়ন এখন যেকোন ছেলের হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়িয়ে দেয়।

মা মারা যাবার মাসখানেক পরে রানুকে তার বড়ো ভাই মামা বাড়িতে দিয়ে যায়। মামা পাশের একটা স্কুলে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মামা বাড়িতে শুরু হলো তার নতুন জীবন। নানির সাথে থাকত। এক এক বেলা এক এক মামির কাছে খেত। আমাদের বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে মা ডাকত। নানান কাজে ও আমাদের বাড়িতে আসতো। আমি একটা অদ্ভুদ ব্যাপার লক্ষ্য করতাম, ‘রানু আমার আম্মাকে আপা ডাকত আর আব্বাকে ডাকত দুলাভাই। অথচ আমাকে ডাকতো রাজু ভাইয়া।’ আমার খালা হলেও বয়সে ছোটো বলে আমি কী ডাকব বুঝতে পারতাম না। ইতস্তত হয়ে নাম ধরে রানু-ই ডাকতাম।

মামা বাড়ি যাবার কদিন পরেই রানু জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর নির্মম সত্য বুঝতে পারল। মামিদের কাছে যে সে বোঝা হয়ে গেছে তা তার বুঝতে বাকি রইল না। দিনে দিনে মামিদের অবহেলা, অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে লাগল। বারান্দায় দাঁড়ালেই আমি দেখতাম, রানু হয়তো অনেক ডেকচি মাজছে কিংবা মামাতো ভাই বোনদের গোসল করাচ্ছে। মাঝে মাঝে বটি নিয়ে অনেকগুলো তরকারি কাটতে বসে। ওর মুখটা সেই আগের মতো নেই। অনেকটা বদলে গেছে। শুকনো মুখে আগের মতো চঞ্চল ভাব নেই। কত বেলা অনাহারে কেটেছে সে নিজেও হয়তো জানে না। এমনও হয়েছে আমার আম্মা আমাদের বাসায় এনে ওকে অনেক বার খাইয়েছে। বাইরে থেকে অপরিচিত কেউ আসলে হয়তো ভাবত রানু বাড়িওয়ালাদের কাজের মেয়ে। মাসখানেক পরে মামি ওর গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছিল। ও সেদিন নিষ্প্রভ দাঁড়িয়ে ছিল। একটা টুঁ শব্দও করেনি। রাত্রিবেলা নানিকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল সেদিন। হয়তো নিজের মাকে খুব স্বার্থপর মনে হতো তার। তাকে ফেলে উনি পরম নিশ্চিন্তে নীরবে ঘুমোচ্ছেন।

এসএসসি পরীক্ষা কাছে চলে এসেছিল। আমি রাত জেগে পড়তাম। একদিন অনেক রাতে পড়ে ওঠে দরজা খুলে আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। আমাদের বাসা দুই তলায়। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দরজার চৌকাঠে মাথা ঠেকিয়ে রানু বসে আছে। আকাশে তখন গোলাকার রুটির মতন চাঁদ হাসছে। অসংখ্য তারা মিটিমিটি জ্বলছে স্থির জোনাকির মতো। শ্বেত জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হচ্ছে পুরো গ্রাম। চাঁদের সেই সফেদ আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটা নিঃশব্দে, নীরবে কাঁদছে। অদ্ভুত রহস্যময় সে কান্না। চোখের জলে একাকার হওয়া মুখটাতে অরণ্যের মায়া পড়েছে। মনে হলো আকাশ থেকে কান্নাপরি নেমে এসেছে। মোহের জালে জড়াতে জড়াতেও জড়ালাম না। মাথা ঝাড়ি দিয়ে বাসায় ঢুকে গেলাম।

এতসব কষ্টের মধ্যেও রানুর একমাত্র বেঁচে থাকার ভিত্তি ছিল বাড়িওয়ালার মা। মানে তার নানি। এই একটা মানুষের কাছেই শুধু ভালোবাসা আর স্নেহ পেত সে। কিন্তু বিধাতা যে তার কপালে সুখ লিখেনি। অভাগী যেদিকে যায় সেদিকেই সবকিছু শুকিয়ে যায়। মাসখানেক পরে মায়ের মতো নানিটাও তাকে ফেলে চলে গেল না ফেরার দেশে। ভীষণ অসহায় হয়ে গেল সে। সেদিনের ওর আহাজারি, বিলাপগুলো এখনো আমার কানে বাজে। দাগ কাটে হৃদয়ের গভীরে। সময়ের কাছে মানুষ যে কতটা অসহায় হতে পারে সেদিনই বুঝেছিলাম।

⏩ আরও পড়ুন: আত্মজা | আবুল হাসনাত বাঁধন

এসএসসির পর আমি কলেজে ভর্তি হয়ে শহরে চলে আসলাম। মাঝে মাঝে বাড়িতে গেলে দেখতাম রানুকে। অনেক শুকিয়ে গেছে সে। মুখের মায়া মায়া ভাবটাও ছিল না। পড়াশুনার চাপে কখনো তাকে নিয়ে ভাবা হয়ে ওঠেনি। শহরের ব্যস্ত জীবনে ওর কথা ভাবার সময়-ই ছিল না। ইন্টার পরীক্ষার আগে একবার বাড়িতে এসে শুনলাম রানু নাকি কোনো একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। আমি মনে মনে খুশিই হলাম। যাক, মেয়েটা ভালোবাসার মানুষ নিয়ে সুখে থাকুক। অতীতের সব দুঃখ মুছে গিয়ে সুখেরা জায়গা করে নিক তার জীবনে। আমি কি জানতাম? তার জীবনে দুঃখেরা চিরস্থায়ী আসন গাড়তে চলেছে।

সময় বয়ে চলল আপন গতিতে, নদীর স্রোতের মতো। আমাদের জীবনও থেমে থাকেনি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা চলে আসলাম। ততদিনে রানু হারিয়ে গেছে আমার স্মৃতির কোটর থেকে। সময়ের সাথে সবকিছু বদলে গেল। কখনো তাকে মনে করার চেষ্টাও করিনি। লেখালেখি করার সুবাধে একজনের সাথে ভালো পরিচয় হয়েছিল। নাম তাসনিয়া। আমার সম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা লেখে। অদ্ভুত লেখনী। শব্দ আর ছন্দের মায়াজালে আটকে যাই। মেয়েটা তার কবিতার মতোই। মাঝে মাঝে মনে হয় আমার সব গল্পের নায়িকা তাসনিয়া-ই। তাকে এখনো মুখ ফুটে কিছু বলিনি। তবে আমরা দুজন দুজনের চোখের ভাষা বুঝি। তাসনিয়া থাকতে রানুর কথা মনে পড়ার কথা-ই না।

কিন্তু আজ হঠাৎ করেই রানুর সাথে দেখা। আমি সবজি কিনতে বাজারে গিয়েছিলাম। আচম্বিতে হলুদ রঙের শাড়ি পরা, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক দেওয়া এক মেয়ে এসে বলে, ‘কেমন আছেন? রাজু ভাইয়া!’ আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে আবিষ্কার করলাম, আরে এটা তো রানু! এখন ওর বয়স আনুমানিক আঠারো হবে। কবির ভাষায়- “ভয়ংকর বয়স!” যৌবন উতলে পড়ছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ও আবার বলল, ‘রাজু ভাইয়া! কেমন আছেন?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘ভালো! তুমি কেমন আছো? তোমার স্বামী কই? দেখতেছি না যে!’
রানু একটু মলিন ভাবে হাসলো। উত্তর দিলো না।
‘কী হলো? উত্তর দিলে না যে?’ আমি আবারও প্রশ্ন করলাম।
‘আমার আবার স্বামী ভাইয়া! বাজারের সবাই আমাকে চিনে। আপনি তাড়াতাড়ি চলে যান। আমার সাথে দেখলে আপনার মান-সম্মানের ক্ষতি হবে।’ মাথা নিচু করে কথাগুলো বলল রানু।

আমার মাথায় কিছু ঢুকল না। ওর কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলাম না। অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। রানুকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বলো এসব, বুঝি না তো? তুমি ঢাকায় কেমনে? স্বামী নেই মানে?’ রানু উত্তর দিলো, ‘হ্যাঁ। আমি আর ভালো মেয়ে নেই ভাইয়া। আমার শরীরে অনেক পাপের দাগ। এই বাজারের অনেকেই আমার শরীর ভোগ করেছে। কারণ আমি এখন নিষিদ্ধপল্লীর বাসিন্দা।’
কথাগুলো যেন আমার মস্তিষ্কে সজোরে আঘাত করল। আমি যেন মাত্রই আকাশ থেকে পড়লাম। তবুও নিজেকে একটু স্থির করে আবার বললাম, ‘এসব কেমনে হলো? আমিতো শুনেছি, তুমি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলে।’
রানু উত্তর দিলো, ‘সে অনেক কথা ভাইয়া। এখানে বলাও যাবে না। আপনার কাছে হয়তো শুনার সময়ও নেই।’ তবুও আমি বললাম, ‘না আমি শুনব। চলো কোথাও বসি।’

⏩ আরও পড়ুন: এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন

রানুকে নিয়ে নির্জন একটা রেস্টুরেন্ট এ বসলাম। ওয়েটার খাওয়ার এনে দিলো। খেতে খেতে রানুর পুরো কাহিনি শুনলাম।

“এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। আমাদের বাড়িওয়ালাই করিয়েছিলেন। কলেজে উঠেই পরিচয় জাহেদ ছেলেটার সাথে। ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গভীর হলো। একে অন্যকে ছাড়া কিছু বুঝত না। জাহেদ প্রতিদিন সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখাতো রানুকে। সেই স্বপ্নের সন্ধানে রানু মামা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জাহেদের হাত ধরে। ভেবেছিল এবার হয়তো সকল দুঃখ ঘুচে গিয়ে সুখ আসবে। জীবনটা হবে স্বপ্নের মতো। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই হতভাগীর কপাল পুড়া। জাহেদ ছিল একজন কোটনা। বেশ্যাপল্লীর দালাল। ঢাকায় এনে ওকে বিক্রি করে দিলো বেশ্যাপল্লীতে আর কেটে পড়ল নতুন কোনো শিকারের আশায়। রানুও নিয়তিকে মেনে নিয়ে হার মানলো সবার কাছে। আর সেই থেকে শুরু হলো ওর নষ্ট জীবন।”

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। খাওয়া শেষে দেখি, রানুর দুচোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসি। সকালে বৃষ্টি পড়েছিল। এখন বৃষ্টি নেই। আকাশে কালো মেঘ জমে থমথমে হয়ে আছে। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। রানু চলে গেলে আমি তার যাওয়ার পথের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সত্যিই কি বোবা চাহনি ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই? নাকি আমিও এই নষ্ট সমাজের নষ্ট মানুষগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছি এই মুহূর্তে?

ঢাকা শহরে সন্ধ্যা নেমেছে। সোডিয়াম বাতির হলুদ আলোয় আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছি। ঝড়ো বাতাস বইছে। তৃষ্ণার্ত প্রকৃতি দেখেই বুঝা যায় ঝুম বৃষ্টি নামবে। রাস্তায় অনেক মানুষের ভিড়। ভিড়ের মাঝে দেখি, তাসনিয়া এগিয়ে আসছে আমার দিকে। হাতে গিফট পেপারে মোড়ানো কিছু একটা। কী ওটা? কবিতার বই?

গল্প: অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প

লেখা: আবুল হাসনাত বাঁধন

রচনাকাল: ১৮/০৫/২০১৬

স্থান: কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম।


অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প – গল্পটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা ‘অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প‘ এর মতো আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে গল্পীয়ানের সাথে কানেক্টেড থাকুন।

[কিওয়ার্ডস:

অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প – আবুল হাসনাত বাঁধন,

অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প : আবুল হাসনাত বাঁধন,

ছোটোগল্প]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: