আমার পাশের সিটে বসে থাকা লোকটা বেশ অনেকক্ষণ ধরে বিশ্রীভাবে নাক ডেকেই যাচ্ছে। এই বিশ্রী নাক ডাকার শব্দ আমার কান দিয়ে মগজে প্রবেশ করে মগজ ওলটপালট করে দিচ্ছে। মাথা খুলে মগজ বের করার কোনো সিস্টেম থাকলে দেখা যেত ওলটপালট হওয়ার কারণে মগজ ভুনা ভুনা হয়ে গেছে। আমার ছোটো বোন তিতলির গোরুর মগজ ভুনা খুবই পছন্দ। কোরবানির সময় অধিকাংশ মগজ ওর পেটেই যায়। আমি নিশ্চিত আমার ভুনা ভুনা হয়ে যাওয়া মগজ পেলেও তিতলি বলত, ‘অসাধারণ! তোর মগজ ভুনার এত স্বাদ আগে বলিসনি তো ভাইয়া।’
এমনিতেই প্রত্যেকবার ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার সময় মন মেজাজের ঠিক থাকে না তার ওপর আবার যাত্রাপথে এমন আপদ জুটলে মনে হয় সবকিছু ছেড়েছুড়ে মঙ্গলগ্রহে চলে যাই। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার কারণে ভ্যাপসা গরমটা অনেকখানি কেটে গেছে। বাসের জানালা দিয়ে মুখ বের করে বাইরের চলন্ত প্রকৃতি দেখায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করছি যাতে নাক ডাকার ওই বিশ্রী শব্দ সহ্যের বাঁধ না ভেঙে দেয়। অবশ্য হেলপার ছেলেটা কিছুক্ষণ পরপর আমাকে চোখ রাঙিয়ে বলছে, ‘এই যে ভাই, জান্না দিয়া মুখ বাহির করতাছেন কিহের লাইগা? কিছু একটা হইলে তো সব দোষ আমাগো ঘাড়েই দেবেন। আমাগো তো আবার গন্ধ বেশি!’
মেজাজের তাপমাত্রা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই, তারপর আবার এই পিচ্চি ছোকরার চোখ রাঙানি তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মনে মনে বলছি, ‘আমি লক্ষ বার কোটি বার জানালা দিয়ে মুখ বের করে রাখব। তোর কী রে ছোকরা!’ মনে করছে এই উপদেশ বাণী বর্ষণ করলেই যেন ওদের সাত খুন মাফ হয়ে যাবে। সেই তো লক্কর ঝক্কর গাড়ি যুগ যুগান্তর ধরে রাস্তায় চালিয়ে যাচ্ছে আর একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
মনে মনে খুব করে চাইছি পরের স্টপেজেই যেন পাশের লোকটা নেমে যায়। তা না হলে নিশ্চিত আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কোথায় যাব আর কোথায় নামব সব গুলিয়ে ফেলব। অবশ্য আমার চাওয়াগুলো কখনোই পাওয়া হয়ে ওঠে না। যদি কখনো কোনো কিছু চাওয়ার সাথে সাথেই পেয়ে যাই তবে সেটা হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আশ্চর্যজনক ঘটনা। সুতরাং বুঝতেই পারছি এই লোকটাকেও সহ্য করে যেতে হবে এবং পাগল হয়ে এক সময় ভুলভাল বকা শুরু করে দেবো। দেখা যাচ্ছে লোকটাকে বলে বসব, ‘অ্যাই, তুই কি কুম্ভকর্ণের চাচাতো ভাই? আর একবার নাক ডেকেছিস তো তোর নাক কেটে পা* দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো।’
এসব চিন্তা করতে করতেই দেখি বাস পরের স্টপেজে থেমেছে। হেলপার ছেলেটা এসে পাশের লোকটাকে বলছে, ‘এই যে ওঠেন। আর কত ঘুমাইবেন! আপনের জায়গা চলে আসছে।” আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিৎকার দিতে গিয়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলালাম। এই প্রথম আমার জীবনে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে! কিছু চাওয়ার সাথে সাথেই তা পূরণ হয়ে গেছে।
লোকটা নাক ডাকা থামিয়ে চোখ পিটপিট করে রাগী রাগী মুখ করে এদিকওদিকে তাকাচ্ছে। ঘুম ভাঙানো হয়েছে বলে যেন সে মহাবিরক্ত। মনে হচ্ছে, এই বাসেই নাক ডেকে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গোটা জীবন পার করে দেওয়ার অসীম ক্ষমতা নিয়ে লোকটা জন্ম গ্রহণ করেছে। নিশ্চয় বাড়িতে বউয়ের অত্যাচারে শান্তি মতো ঘুমাতে পারে না!
বাইরে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাসের সামনের দিকে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। পেছনের আলোগুলো নিশ্চয় খারাপ হয়ে গেছে বলে পেছনে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। এই অন্ধকারটা অবশ্য উপভোগ করছি। ওই স্টপেজেই অনেকে নেমে গেছে বলে বাস বেশ ফাঁকা ফাঁকা। লোকটা নেমে যাওয়ায় গা এলিয়ে আরাম করেই বসেছি। চাইছি আর কেউ যেন আমার পাশে না বসে। বাকি পথটুকু একটু আরামের সহিত যেতে চাচ্ছি। অবশ্য কেউ বসার সম্ভাবনাও কম। সামনের দিকে হাতেগোনা কজন যাত্রী।
নতুন স্টপেজে বাস থেমেছে। একটা ছেলে নেমে গেল। নতুন কেউ আর উঠবে বলে মনে হয় না। হঠাৎ সামনের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল। এক সতেরো আঠারো বছরের তরুণী এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে কমলা রঙের পাতলা শিফনের শাড়ি। শরীরের বাঁকগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠেছে। আমি বিব্রত হয়ে চোখ ফিরিয়ে জানালার বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টিপাত করলাম। চাইছি এই মেয়েটি যেন আমার পাশে কোনোভাবেই না বসে।
‘আমি কি আপনার পাশে একটু বসতে পারি?’
মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠস্বর কানে যেতেই তাকিয়ে দেখি মেয়েটি দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখমণ্ডল যদিও ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না। আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে লাগলো। অনেক সিটই তো ফাঁকা আছে তাহলে আমার পাশেই বসতে হবে কেন! তবে ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে না করতে পারলাম না। আমি একটু সরে এসে বসার জায়গা করে দিলাম।
‘আপনি নামবেন কোথায়?’ মেয়েটি বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল।
আমি ইতস্তত করে বললাম, ‘আমার নামতে এখনো বেশ দেরি আছে।’
‘তাই! আমারও ওরকমই লাগতে পারে। দুজন মিলে গল্প করতে করতে সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আশা করি সময়টুকু উপভোগ্য হবে।’
একজন অচেনা অজানা মেয়ের সাথে কী গল্পই বা করব আর কী গল্পই বা থাকতে পারে! এসবে আমি মোটেও অভ্যস্ত নই। আমি কোনোরকমে বললাম, ‘জ্বি অবশ্যই।’ বলেই আঁড়চোখে মেয়েটিকে ভালোভাবে দেখার চেষ্টা করলাম। বাসের পেছনে তো অন্ধকার কিন্তু জানালার বাইরে থেকে আসা আবছা আলোয় বেশ রূপবতী বলেই মনে হচ্ছে।
‘আপনার সম্মতি পেয়ে গেলাম তাহলে তো আর কথায় নেই। এ যাত্রা দারুণ হবে!’ মেয়েটির স্বরে কেমন যেন আকুলতা।
এ আকুলতা আমার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিলো। আমি আর কিছু না বলে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। খেয়াল করছি মেয়েটি একটু বেশিই আমার গা ঘেঁষে আমার দিকে সরে আসছে। আমি যতই নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি ও ততই ঘেঁষে আসছে। ও কি ইচ্ছে করেই এমন করছে নাকি আমিই ভুল ভাবছি? ঠিক বুঝতে পারছি না।
রাতের আঁধার ভেদ করে বাস এগিয়ে চলেছে। মেয়েটি আর কোনো কথা বলছে না। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি! মাথা ঘুরিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না। ওর দিকে তাকালেই যদি আবার বকবক শুরু করে দেয়। পেটের ওপর একটা স্পর্শ পেলাম। এ কী! মেয়েটার একটা হাত আমার পেটের ওপর এসে পড়েছে। ঘুরে তাকাতেই দেখি ঘাড় কাত করে গভীর ঘুম। বাসে উঠলেই সবার ঘুম কেন পায় বুঝি না। মাথাটা সোজা করে সিটের সাথে হেলান দিয়ে দিতে গিয়ে আমার কাঁধে এসে পড়ল। মহা মুশকিল হলো তো! মাথা আমার কাঁধে আর একহাত পেটের ওপর। এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখলে যে কেউ ভাববে আমরা স্বামী স্ত্রী। ঠিক হয়ে বসতে যে বলব তার উপায়ও নেই। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করছে না। মায়া হচ্ছে কেন যেন। আমি ভালোভাবে কাঁধ পেতে দিলাম যাতে আরাম করে একটু ঘুমুতে পারে।
এই প্রথম এতটা কাছ থেকে কোনো মেয়ের স্পর্শে পূর্ণ হচ্ছি। অন্ধকারে চলন্ত বাসে একটা মেয়ে এভাবে কাঁধে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে ভাবতেই কেমন লাগছে! এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে একটু একটু করে। একটা মেয়ের স্পর্শে একটু হলেও কামনা বাসনা জাগ্রত হবে এটাই স্বাভাবিক। পুরুষ মানুষ তো!
আচ্ছা, আমার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ হলে কি এই অবস্থায় নোংরা কিছু করার সুযোগ নিতো? পরিস্থিতি তো পুরোপুরি অনুকূলে। কিন্তু আমি তো এসব কল্পনাও করতে পারি না। মেয়েরা আমার কাছে সবসময়ই একজন মানুষ। মেয়েদের আমি কখনো মেয়ে হিসেবে দেখিনি, চিরকাল মানুষ হিসেবেই দেখে এসেছি। প্রাণপণ চেষ্টা করছি এই মুহূর্তে কোনো নোংরামি যেন আমাকে গ্রাস না করে।
জানালা দিয়ে শীতল বাতাস আসছিল। লাগিয়ে দেয়ার পরও শীত শীত লাগছে। মেয়েটি গুটিসুটি হয়ে এখনো আমার কাঁধে মাথা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। চরম বিব্রত বোধ করলেও কিচ্ছু করার নেই। আমার ব্যাগে একটা চাদর আছে। ব্যাগ গুছানোর সময় মা দিয়ে দিয়েছিলেন। চাদরটা আস্তে করে বের করে ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। চাদরের উষ্ণতায় ও যেন আরও তৃপ্তি পেয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
আমিও বোধহয় একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। একটা ঝাঁকুনিতে জেগে গিয়ে দেখি প্রায় চলে এসেছি। পরের স্টপেজেই নামতে হবে। মেয়েটি আরও গভীরভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এখন ডাকতেই তো হবে। আমার নামার সময় হয়ে গেছে।
‘শুনছেন? উঠুন। আমাকে নামতে হবে পরের স্টপেজেই।’ একটু গলা উঁচিয়ে বললাম। মেয়েটি চোখ মেলে তাকিয়েই তাড়াহুড়ো করে আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল। সে যে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়ে গেছে বুঝাই যাচ্ছে।
‘আমি খুবই দুঃখিত। কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলাম বুঝতেই পারিনি। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম।’ মেয়েটি ইতস্ততভাবে কথাগুলো বলল।
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘কোনো ব্যাপার না। হয়তো আপনি অনেক ক্লান্ত ছিলেন তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।’
মেয়েটি নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ‘সত্যিই প্রচণ্ড ক্লান্ত আমি, জানেন? আর পারছি না। জীবনের কাছে অনবরত হারতে হারতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।’
এ কথাগুলো কেন বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। মেয়েটির মুখের দিকে তাকালাম। আবছা আলো আঁধারের খেলায় তার মুখমণ্ডলের কোনো অভিব্যক্তি বুঝার উপায় নেই। আচ্ছা, মেয়েটি কি কাঁদছে? কিন্তু কেন?
বাস থেমেছে। নামতে হবে। মেয়েটি বলেছিল সেও নাকি এই স্টপেজেই নামবে। নেমে পড়লাম। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। লোকজন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি। জোরে হর্ন বাজিয়ে বাস চলে গেল। আমি মেয়েটির দিকে ঘুরে তাকাতেই হা হয়ে গেলাম। রাস্তার নিয়ন বাতির আলোয় তার মুখচ্ছবি স্পষ্ট হলো। যেমন ভাবছিলাম তারচেয়েও কয়েকগুণ বেশি রূপবতী সে। কিন্তু চোখ দুটোতে যেন বিষাদের ছায়া। সেই বিষাদ অনেক কিছুই বলতে চাইছে।
নীরবতা ভেঙে বললাম, ‘কোথায় যাবেন আপনি? আপনাকে কি এগিয়ে দেবো? রাস্তাঘাট তো প্রায় ফাঁকা। বেশ রাত হয়ে গেছে।’
মেয়েটি চোখমুখ শক্ত করে বলল, ‘না, না। আপনি চলে যান। আমাকে একজন নিতে আসবে। রাতকে আমি মোটেও ভয় পাই না তবে ঘৃণা করি। আমাকে নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।’
মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কেমন যেন একটা রহস্যের পর্দায় নিজেকে মুড়ে রেখেছে। টুক করে সেই পর্দা ভেদ করা অসম্ভব।
আমার মেসবাড়ি এখান থেকে কাছেই। হাঁটতে হাঁটতেই চলে যাওয়া যাবে। মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করেছি। আমার কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটি আমার চলে আসার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। পেছন ফিরে দেখলেই হয় কিন্তু দেখতে চাচ্ছি না।
‘দাঁড়াবেন একটু?’ মেয়েটির কণ্ঠস্বর পেয়ে চমকে উঠলাম। কোনো বিপদ হলো না তো! আমি ঘুরে তাকাতেই দেখি জোরে জোরে পা ফেলে এদিকেই আসছে। কাছে এসেই দ্রুত নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দু ধাপ পেছনে সরে গিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম, ‘করছেন কী! উঠুন উঠুন। কে আপনি বলুন তো?’
মেয়েটি পায়ের কাছ থেকে উঠে মুচকি হেসে বলল, ‘ভগবান কে প্রণাম করব না তাই কি হয়? পাপ হবে যে!’
আমি এক সমুদ্র বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কী যে হচ্ছে! মেয়েটির মুখে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। অনেক কিছু বলার জন্য যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে বলল, ‘আমি দ্রৌপদী। দ্রৌপদী দত্ত। রাতের বেলা অবশ্য প্রিন্সেস দিশা হয়ে যাই। মহাভারত বাবার অসম্ভব প্রিয় বলে জন্মের পর শখ করে এই নাম রেখেছিলেন। তবে মহাভারতের দ্রৌপদীর সাথে আমার পার্থক্য কী জানেন? ওই দ্রৌপদী পাঁচজন স্বামীর সাথে সংসার করেছিল আর আমার সংসারটা হয়নি; তবে পাঁচ রকম লোকের সাথে প্রতিদিন রাতে বিছানায় শুতে হয়।’
আমি একটা ধাক্কা খেলাম। কত সহজ স্বাভাবিকভাবেই না অল্পবয়সি এই মেয়েটি কথাগুলো বলে দিলো। জীবন ওকে হয়তো অনেকখানি বড় করে দিয়েছে, যুদ্ধ করতে শিখিয়ে দিয়েছে। অস্ফুটস্বরে আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো, ‘কী বলছেন আপনি!’
মেয়েটি হাসলো। সে হাসি যেন তীব্র বিদ্রুপ ছুঁড়ে দিলো। এরপর নিঃসংকোচে বলল, ‘সাহেবরা দিনের বেলায় মুখোশ পরে ডাকে ‘বেশ্যা’ বলে আর রাতের বেলায় সেই মুখোশ সোজা বিছানায় গিয়ে খুলে পড়ে। তখন তাদের চায় শুধুই শরীর আর মাংস। জানেন তো, নারী মাংসের কোনো জাত, পাত, ধর্ম হয় না। শুধু মাংসটুকু হলেই চলে।’
বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করে ওঠল। আমি কোনো কথা বলতে পারছি না। হয়তো কথা বলার শক্তিটুকু সাময়িক সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হয়ে আসতে চাইছে না। একদৃষ্টে দ্রৌপদীর দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ঠিক কতখানি দগ্ধিত হলে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে!
দ্রৌপদী আবার স্বাভাবিকভাবে বলতে শুরু করল, ‘বাবা হঠাৎ করেই হুইলচেয়ারের বাসিন্দা হয়ে গেল। মা’র বিছানা থেকে সোজা হয়ে উঠে বসার ক্ষমতা নেই। হন্যে হয়ে এ শহরে একটা কাজ খুঁজেছি। না পাইনি। যেখানেই গেছি সেখানেই আশাহত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। পেটে ক্ষুধার জ্বালা। বাড়ি ভাড়ার টাকার জন্য প্রতিনিয়ত বাড়িওয়ালার চোখ রাঙানি। জীবন যুদ্ধে বারবার হারতে হারতে আহত এক সৈনিক হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক তখনই একজন এই পথ দেখিয়ে দিলো। শরীরের বিনিময়ে টাকা। একটু ভালো থাকার জন্য কী আর করার ছিল বলতে পারেন?’
এই প্রশ্নের উত্তর যে আমার কাছে নেই। জীবন কখনো কখনো বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন এমন হয়? কেন দ্রৌপদীদের ভালো থাকা হয় না। আমি দ্রৌপদীর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না। আশ্চর্য এক অপরাধবোধ কাজ করছে। আমি নিশ্চুপ।
দ্রৌপদী অদ্ভুতভাবে হেসে আবার বলা শুরু করেছে।
‘প্রত্যেক রাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে আঁধারের মাঝে আমি শুধু দু পেয়ে কিছু জন্তু দেখতে পাই। তারা আমাকে খুবলে খুবলে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। এই অসংখ্য দু পেয়ে জন্তুগুলোর মাঝে আমি রোজ একজন মানুষ খুঁজে বেড়াই। তাই প্রায়ই অদ্ভুত একটা কাজ করি, জানেন? সেদিন সমস্ত টাকাপয়সার হিসেবে নিকেশ দূরে সরিয়ে রাখি। কাজটা হলো, কোনো কোনো রাত্রিতে চলন্ত বাসে উঠে কারও পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পড়ি আবার বসার জায়গা না পেলে ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে যাই। বাস চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর বুকে, পেটে, নিতম্বে, দু পায়ের ফাঁকে হাতের অস্তিত্ব টের পাই। আমি কিছু বলি না। নিজেকে আরও ভালোভাবে মেলে ধরি। আমার খুব খুব হাসি পাই। হায় পুরুষ! এটুকু সময়ের মধ্যেও নারীর শরীরের আস্বাদন নিতে ভুল হয় না। নেমে যাওয়ার সময় কানে কানে বলি, শুধু একটা দণ্ড থাকলেই পুরুষ হওয়া যায় না। ওরা চরম লজ্জা পেয়ে কাচুমাচু মুখ করে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে। এই আঘাতটুকু দিয়ে আমি পরিতৃপ্ত হই। ওরা ওদের পুরুষত্বের দৌড় কত তা বুঝতে পারে নিশ্চয়।
আমি যতবার রাত্রিতে বাসে উঠে এই পরীক্ষাটা করেছি ততবারই আশাভঙ্গের বেদনায় নীল হয়েছি। কারও না কারও হাতের ঘৃণ্য স্পর্শ আমার শরীরে এসে পড়েছে। এর ব্যতিক্রম হয়নি একবারও। শুধু প্রশ্ন জেগেছে একজন মানুষ কি খুঁজে পাব না কোনোদিন?’
দ্রৌপদী থামল। এক নাগাড়ে কথাগুলো বলাতে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে তাই একটু নিশ্বাস নিলো। এবার দ্রৌপদী আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করছে। ও এত দারুণ করে নির্মম সত্যগুলো বর্ণনা করছে যে মুগ্ধ হয়ে শুনছি। একটুও বিরক্তবোধ করছি না।
‘আমি আর খুব বেশি সময় নেবো না। আপনাকে আরেকটু আটকে রাখব। কথাগুলো যে বলতেই হবে।’ দ্রৌপদীর গলায় আকুতি।
‘আপনি বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই।’ দ্রৌপদীকে অভয় দিলাম।
দ্রৌপদী নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে শুরু করল, ‘বাসে উঠেই আপনার দিকে নজর গেল। ভাড়া মিটিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে আপনার পাশে বসে পড়লাম। আপনি কি ভেবেছিলেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? না, একদম না। সারা রাস্তা ঘুমের ভান করেছিলাম। যেটা সবার সাথেই করি। আপনি ভুল করেও আমার শরীরে স্পর্শ তো দূরে থাক ভালো করে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন না পর্যন্ত। আবার আমি যাতে আরামে ঘুমাতে পারি তাই আমার মাথা আপনার কাঁধে নিলেন, এত যত্ন করে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে আগলে রাখলেন যে আমার চোখে পানি চলে আসলো। আজ আমার পরীক্ষায় ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। আমি মনে মনে বললাম, পেয়েছি! এত এত দু পেয়ে জন্তুর ভিড়ে আজ একজন সত্যিকারের পুরুষ, সত্যিকারের একজন মানুষের খোঁজ আমি পেয়েছি। আমার মাথাটা আপনার কাঁধে নেওয়ার সময়, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে দেওয়ার সময় আপনার যতটুকু স্পর্শ আমার শরীরে লেগেছে ওই স্পর্শটুকু আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখব। এর থেকে শুদ্ধ, এর থেকে পবিত্র স্পর্শ আর হতে পারে কি! সবাই তো স্পর্শ করে কিন্তু সেই স্পর্শগুলো যে ঘৃণায় পরিণত হয়। তাই আপনি আমার কাছে শুধু একজন পুরুষ কিংবা সত্যিকারের মানুষ না; আপনি আমার কাছে ভগবানের আরেক রূপ। আর ভগবান কে যে প্রণাম করতেই হবে। পঙ্কিলতার মাঝেও আপনার মতো শুদ্ধ মানুষেরা আছে বলেই হয়তো এ পৃথিবী এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। আমার কথা শেষ হয়েছে। আপনি এখন যেতে পারেন। আপনার মঙ্গল হোক সেই প্রার্থনায় করি।’
দ্রৌপদী থামল। হতভম্ব হয়ে দ্রৌপদীকে দেখছি। আমি বাকরুদ্ধ! দ্রৌপদীর বাসে উঠা থেকে নামা পর্যন্ত রহস্যময় কর্মকাণ্ডের পুরোটা এবার পরিষ্কার হলো। কিন্তু দ্রৌপদী যেভাবে আমাকে সম্মানিত করল, সত্যিই কি আমি এতকিছুর যোগ্য? ওকে আমার শুধু একটা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না এখন। দ্রৌপদী নামের এই তরুণীটিকে আমার কাছে আর সবার থেকে আলাদা এবং উন্নত একজন মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। মহীরুহের মতো মানুষটার সামনে আমি অতি ক্ষুদ্র নগন্ন একজন। সে আমার মতো ক্ষুদ্র এক মানুষকে এত মর্যাদা দিয়েছে যে তা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হিসেবে রয়ে যাবে। কত সহজভাবেই না দ্রৌপদী এ সমাজের পুরুষ মানুষগুলোর ঘৃণ্য দিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। একজন পুরুষ হিসেবে এ যে বড় লজ্জার!
‘আপনার কাছে একটা জিনিস চেয়ে নেবো, দেবেন?’ দ্রৌপদী আমার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে।
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘অবশ্যই। কী বলুন?’
দ্রৌপদী উত্তর দিলো, ‘আপনার চাদরটা। ওটাতেও আপনার স্পর্শ লেগে আছে। পশুগুলোর কাছে ক্ষতবিক্ষত হওয়া শেষে চাদরটা আমি বুকে জড়িয়ে রাখব। তখন জানব অন্তত একজন মানুষের ছোঁয়া আমার সাথে আছে সবসময়।’ কথাটা আমার বুকে কোথায় যেন ধাক্কা দিলো। আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলাম। দ্রৌপদী হাসলো কিন্তু চোখে অশ্রু টলমল করছে। কারও হাসি এতটা সুন্দর হতে পারে আমার জানা ছিল না!
দ্রৌপদীর কাছ থেকে শেষ বারের মতো বিদায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছি। ওর সেই মায়াময় মুখটা বারবার চোখের খুব সামনে চলে আসছে। অনেকটা পথ চলে এসেছি। পেছন ফিরে দূর থেকে দেখতে পেলাম দ্রৌপদী একটা বড় গাড়িতে ওঠছে। মুখোশ পরা নিষ্ঠুর এ শহরে আবার একটা ক্ষতবিক্ষত রাত এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দ্রৌপদীর সামনে। ওর গায়ে জড়ানো আমার দেওয়া চাদরটা।
মনে মনে প্রার্থনা করলাম, দ্রৌপদীর মেঘে ঢাকা জীবনে আলো ঝলমলে রোদ্দুর হয়ে একজন সত্যিকারের মানুষ আসুক। একজন অর্জুন আসুক। যার উত্তাপে বিলীন হয়ে যাবে যাপিত জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা। যার ভালোবাসাময় স্পর্শে দ্রৌপদী ভালো থাকবে। খুব ভালো।
******
আরও পড়ুন: বই রিভিউ | একা [উপন্যাস] – মৌলী আখন্দ
আরও পড়ুন: একটি ইঞ্জিন ও হলুদ জামা [প্রতিযোগিতার গল্প]
কীওয়ার্ডস: [ একজন মানুষের খোঁজে – তানভীর তূর্য , একজন মানুষের খোঁজে , তানভীর তূর্য , একজন মানুষের খোঁজে | তানভীর তূর্য , গল্পীয়ান , জীবনধর্মী গল্প , নন-ফিকশন , একজন মানুষের খোঁজে | ছোটোগল্প , প্রতিযোগিতার গল্প , ছোটোগল্প , বিয়োগাত্মক গল্প , একজন মানুষের খোঁজে : তানভীর তূর্য , তানভীর তূর্যের গল্প – একজন মানুষের খোঁজে ]