এক.
বৃষ্টি শুরু হলো।
অ্যালানের হাতের ওপর এক ফোঁটা পানি পড়তেই ওর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। এসব মানতে পারছে না ও।
কেমন করে সম্ভব এটা? অ্যালানের চোখ থেকে এখনো বিস্ময় যায়নি। মাথা উঁচু করে ধূসর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আরও এক ঝাঁক বৃষ্টি ওর দিকে ধেয়ে আসছে।
সট করে মাথা নামিয়ে ফেলল অ্যালান। বৃষ্টি যেকোনো সময় জোরে চলে আসতে পারে দেখে দেরি না করে দশ হাত দূরে থাকা গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল।
ওর পুরো নাম অ্যালান ভিগার। ভিগার কোন ভাষার শব্দ, এটা জানত না ও। শুধু জানতো ভিগার অর্থ – ‘ভ্রমণকারী’।
‘তাহলে আমি ভ্রমণকারী-ই হব।!’ – সেই চৌদ্দ বছর বয়সে বলেছিল অ্যালান। এজন্য লেখাপড়া আর হয়ে ওঠেনি ওর। তাতে অবশ্য খুব একটা সমস্যাও হয়নি। কারণ অ্যালানের বাবার যত টাকা আছে, সেগুলো দিয়ে ওদের কয়েক প্রজন্ম চলবে। তা ছাড়া ওর নেশাই ওকে আর দশটা শিক্ষিত মানুষের চেয়ে বেশি জ্ঞানী বানিয়েছে। পৃথিবীতে আর মাত্র কয়েকটা জায়গায়ই আছে, যেগুলোতে অ্যালানের যাওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন: একা | মৌলী আখন্দ | রিভিউ: সালসাবিলা নকি
কিন্তু এই জায়গাটা…!! অ্যালান চারিদিকে তাকাল। বিরাট বড়ো বড়ো গাছ মনে হচ্ছে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে কিন্তু লাইন ধরে দাঁড়িয়ে নেই, ওটা স্রেফ মনে হচ্ছে প্রচুর গাছ-গাছালির জন্য। অ্যালান ওপরের দিকে তাকিয়ে ওর পাশের গাছটা কত উঁচু দেখার চেষ্টা করল। সাধারণত কোনো রেইন ফরেস্টের গাছই এত লম্বা হয়।
সবকিছুই ঠিক আছে, শুধু কোথায় জানি একটা গভীর অমিল ধরতে পারছে অ্যালান। ওর ষোলো বছরের অভিজ্ঞতা বলছে এই জঙ্গলে কোনো একটা জিনিসের অভাব আছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালান ধরতে পারল ব্যাপারটা। শব্দ! এখানে বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ আছে, মেঘের গর্জনের শব্দ আছে, এমনকি ও হাঁটলে জুতার নিচে শুকনো পাতার ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দও আছে, কিন্তু আর অন্য কোনো শব্দ নেই। পাখিদের কিচিরমিচির , প্রাণীর দৌড়ে যাবার শব্দ কিংবা ঝোপের আড়ালের খসখস শব্দ কোনোটিই নেই। কিন্তু অ্যালান মোটেও অবাক হলো না, কারণ ও ভালোভাবেই জানে এটা কোন জায়গা।
আরও পড়ুন: আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা | আবুল হাসনাত বাঁধন
বৃষ্টি প্রায় থেমে যাবার সাথে সাথেই অ্যালান আবার হাঁটা শুরু করল। ছোটো বেলায় যখন ও সুন্দর কোনো জায়গায় যেত তখন বলত- ‘এটা তো ছবির মতোন!’ কিন্তু , এখন আর সেরকম কিছু বলবে না। কারণ এটা একটা ছবিই। মানুষের আঁকা ছবি। ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে যেসব ছবি আঁকে, ঠিক সেরকমই একটা সুন্দর জঙ্গলের ছবির ভেতর অ্যালান হাঁটছে। কিন্তু এটা কি সম্ভব? অ্যালান জানে না। সবকিছু দেখার পরও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।
লম্বা লম্বা কদম ফেলে কিছুদূর সামনে এগোনোর পর অ্যালান হঠাৎ করে থেমে গেল। ওর সামনে বড়ো একটা ঝোপ। আর ঝোপের আড়ালে দুটো চিতাবাঘ বসে আছে। গায়ের মধ্যে ছোপ ছোপ কালো দাগ। অ্যালানকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল ওগুলো। উচ্চতা প্রায় ওর বুক পর্যন্ত।
ভয়ে দম আটকে গেল অ্যালানের। নিজের অজান্তেই এক কদম পিছিয়ে এলো সে। এটা ছবি হোক আর যাই হোক না কেন এখানকার সবই সত্যি, ও দেখেছে। আরও এক কদম পিছিয়ে এলো অ্যালান। ও ইচ্ছে করেই এখানে ওর গানটা আনেনি। অবিশ্বাস করেছিল সবকিছু।
চিতাবাঘ দুটো এক কদম আগালো। দুই কদম। তিন কদম। তারপর হিংস্র একটা আওয়াজ করে লাফ দিলো ওর দিকে।
অ্যালান উলটো দিকে ঘুরে সর্বশক্তি দিয়ে দৌড় দিলো। আর বেশিক্ষণ না, তিন সেকেন্ডের মধ্যেই ওর কণ্ঠের হাড় গুড়িয়ে দেবে চিতাগুলো।
‘ফিলা, ফিলা, ফিলা…’ গতি না কমিয়ে অ্যালান চিৎকার করল, ‘এখান থেকে বের করো আমাকে।’ শেষের শব্দগুলো ও এত জোরে বলল যে নিজেই এগুলোর অর্থ বুঝল না।
দুই.
রাগে গজগজ করছে অ্যালান। আর একটু হলেই মরতে হতো ওকে। তাও আবার একটা ড্রইং এর ভেতর! চেয়ারে বসা অবস্থাতেই পেছনে ফিরল ও। বড়ো একটা কাঠের স্ট্যান্ডে ড্রইংটা আটকানো আছে। ঘন জঙ্গল। আর মেঘলা আকাশ থেকে ঝিরঝির করে এক্ষুনি বৃষ্টি নেমে আসবে মনে হচ্ছে। চোখ দুটো একটু সরু করল অ্যালান। বাঘগুলো কই? কিছুক্ষণ তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল।
অ্যালান এখন ফিলার অফিসে অবস্থান করছে। ফিলাদের বাসা আর অ্যালানদের বাসা ছিল পাশাপাশি। ও আর ফিলা আগে একসাথে স্কুল যেত, একসাথে খেলত, ঘাড় ধরে ঘুরে বেড়াত। কিন্তু অ্যালানের পৃথিবী ভ্রমণের নেশাই ওকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এমনকি নিজের পরিবার থেকেও। ওর…
খুট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। অ্যালান দরজার দিকে তাকাতেই দেখল স্যুট পরা হাস্যোজ্জ্বল চেহারার একজন নারীকে। ফিলা। ও-ই ছবিটার আর্টিস্ট।
ফিলার হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে অ্যালান ওর রাগ ধরে রাখতে পারল না, হেসে ফেলল।
আরও পড়ুন: আমরা তিনজন | বুদ্ধদেব বসু
‘সরি অ্যালান! একটু দেরি হয়ে গেল।’ ফিলা এসে ওর বড়ো চেয়ারটাতে বসল। ওর সামনা-সামনি টেবিলের অপর পাশে অ্যালান বসে আছে।
‘আরে নাহ্, কোনো সমস্যা নেই!’
‘আমার সেক্রেটারি বলল- তুমি নাকি চিৎকার করছিলে ওখানে?’ ড্রয়িংটার দিকে ইশারা করে ফিলা বলল।
অ্যালানের মাথাটা চোঁ করে গরম হয়ে গেল। ও যখন বাঘের ধাওয়া খেয়ে দৌড়াচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে নিজেকে এই রুমে আবিষ্কার করেছিল। ও আচ্ছা, ওই সময় মাথা ন্যাড়া করা যেই ছেলেটা এই রুমে ছিল, ওটাই ফিলার সেক্রেটারি তবে; অ্যালান ভাবল। ওই ব্যাটাকে ড্রইংটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে, তা হলে বুঝবে বাঘের ধাওয়া কাকে বলে।
‘অ্যালান!’
ফিলার কথা শুনে অ্যালানের ভাবনায় ছেদ পড়ল।
‘ও, হ্যাঁ!’ ও বলল, ‘হঠাৎ করে বাঘের মুখে পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। আরে ওই কথা বাদ দাও। তুমি বলো এটার কথা!’ অ্যালান ফিলার আঁকা ছবিটার দিকে ইঙ্গিত করল।
‘কীভাবে সম্ভব এটা, ফিলা?’
ফিলা ঠোঁট চওড়া করল।
আরও পড়ুন: অচেনা বাঁকে | ফাহমিদা বারী
‘এটাকে ব্রেইন দিয়ে চিন্তা করলে কুল কিনারা খুঁজে পাবে না, অ্যালান। এটা এমন একটা জিনিস যেটাকে অন্তর দিয়ে কল্পনা করতে হবে। তবেই তুমি বুঝতে পারবে। জানো অ্যালান, আমার বাবা আমাকে মাঝেমাঝেই বলতেন যে, আদিম মানুষেরা প্রভাবশালী হতো পেশিশক্তি ব্যবহার করে। আর তারপর যখন উন্নত মানুষরা আসলো, তারা ব্যবহার করা শুরু করল ব্রেইন। নিঃসন্দেহে এই ব্রেইনের শক্তি পেশিশক্তির চেয়ে বেশি! পেশিশক্তি যেমন ব্রেইনের শক্তির কাছে নস্যি, ঠিক তেমনি ব্রেইনের শক্তিও মনের শক্তির কাছে কিছুই না। তোমাকে এই ছবি বুঝার জন্য সেই মনের শক্তির প্রয়োগ ঘটাতে হবে, অ্যালান। বুঝলে?’
‘হুম।’
এসব দার্শনিক মার্কা কথা অ্যালানের ভালো লাগে না। অ্যালানের ভাব দেখে ফিলা হাসলো।
‘তোমাকে আসলে আমার ড্রইং দেখানোর জন্য এখানে ডাকিনি অ্যালান। এটা তো কেবল ছোট্ট একটা প্রমাণ, অনেক বড়ো কিছুর, যেটা আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি।’
অ্যালান একটু আগ্রহ দেখাল, ‘কী প্রত্যক্ষ করেছ?’
‘আমার কথা শুনলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে। সবার আগে বলি এই ড্রইংটার কথা। তুমি নিশ্চয় মনে করেছো এই ধরনের ছবি আর কোথাও নেই, তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই তো। এমন আরও ড্রয়িং আছে?’ অ্যালান টেনে টেনে বলল।
‘হু, আছে। শুধু আর একটাই আছে। খুবই পুরোনো একটা ড্রইং। কিন্তু ওটা সম্পর্কে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষেরই কোনো ধারণা নেই। বিশেষ করে আমার কোনো ভাবেই ওটা সম্পর্কে কিছু জানার কথা ছিল না। কিন্তু আমি জেনে গেছি। ওটা কীসের ড্রইং জানো তুমি, অ্যালান?’
আরও পড়ুন: তিথীর মৃত্যু | আরোহী হাসান
অ্যালানকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না ফিলা। বলল, ‘ওটা হলো পুরো একটা পৃথিবীর ছবি। এমন একটা ছবি যার ভেতর গোটা একটা পৃথিবী আছে! আরেকটা পৃথিবী। তুমি কল্পনা করতে পারছো? শত শত বছর ধরে হাজার হাজার শিল্পীরা মিলে ওই ছবিটা এঁকেছে, পুরোপুরি লুকিয়ে। কালের পরিক্রমায় ওটা খারাপ মানুষদের অধিকারে চলে যায়। তারপর কী হয়েছে তুমি আন্দাজ করতে পারছো?’
অ্যালান এসব কী শুনছে, বুঝতে পারছে না। তবুও ফিলার কথার উত্তর দেবার চেষ্টা করল, ‘নিশ্চয় ওরা ওই ছবিটার ভেতরে ঢুকেছে।’
‘না, ওরা ঢুকেনি। কিন্তু গোপনে হাজার হাজার গ্রাম্য, মূর্খ আর গরিব মানুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাদের সাথে সত্যিকার পৃথিবীর তেমন কোনো যোগাযোগও ছিল না। এবং মানুষগুলো ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি যে ওরা একটা ড্রইংয়ের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। তুমি বিশ্বাস করবে না যে, ওই ছবিটা এখনো কোথাও না কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে। আর আমরা চাইলেই ওই ড্রইংটার ভেতর থেকে মানুষগুলোকে বের করে আনতে পারি।
অ্যালান একটু টেবিলে ঝুঁকে পড়ল; ‘কীভাবে?’
‘ভয়! ভয় দিয়ে!’
‘কী!! ভয় দিয়ে? কীভাবে?’ ও ভ্রূ কুঁচকাল।
আরও পড়ুন: নিভৃত ভালোবাসা | সালসাবিলা নকি
ফিলা বলল, ‘তার আগে আমি আবার তোমাকে সরি বলে নিচ্ছি, অ্যালান! কারণ তোমাকে আমি একটা জিনিস বলিনি। আসলে আমি তোমাকে ভয় দেখানোর জন্যই আমার আঁকা এই ছবিটার ভেতর ঢুকিয়েছি। আর বাঘ দুটো এঁকেছি। আমি দেখতে চেয়েছি যে, আসলেই ভয় পেলে ওখান থেকে বের হওয়া যায় কিনা। এবং আমি আমার চেষ্টায় সফল, অ্যালান! প্লিজ মন খারাপ কোরো না। আমি নিজে এমনিতেই ভীতু। ওখানে যাবার সাহস ছিল না আমার!’
‘কিহ্!’ অ্যালানের চোয়াল ঝুলে পড়ল।
‘হ্যাঁ!’ ফিলা হাসলো।
অ্যালান সোজা হয়ে বসে নিজের শেষ মান-সম্মানটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করল।
‘তাহলে চলো ওই ড্রইংটা খোঁজা শুরু করি।’
‘মাই ডিয়ার, অ্যালান! ওটা খোঁজা লাগবে না! কারণ আমরা ওটার ভেতরেই আছি!’
কীওয়ার্ডস: [ এটা তো ছবির মতন – আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের , এটা তো ছবির মতন , আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের , এটা তো ছবির মতন | আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের , গল্পীয়ান , সায়েন্স ফিকশন , কল্পবিজ্ঞান , ফিকশন , রহস্য গল্প , ছোটোগল্প , থ্রিলার ]