এক.
মাথার ওপর ছাতিফাটা রোদ্দুর কিলবিল করছে। আমি বাউণ্ডুলের মতো হাঁটছিই তো হাঁটছিই, পথের শেষ নেই। মাঝেমাঝে মফস্বল শহরের দুয়েকটা সুপরিচিত গাড়ি সাঁই সাঁই করে পাশ কেটে যাচ্ছে আমার। ঠিক কী কারণে, কোন কাজে আমি এখানে এসেছিলাম মনে করতে পারছি না! মাথার ভেতর সেসব বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকদিন পর পূর্বার সাথে দেখা হলো। অনেকদিন বলতে প্রায় বছর তিনেক। মনে হলো আমার ছোট্ট পিচ্চিটা হঠাৎ করে বড়ো হয়ে গেছে। তার সেই কিশোরী মুখে এখন বয়সের গাম্ভীর্য, চোখের নিচে কালশিটে পড়েছে, গালে ইয়া বড়ো বড়ো দুটো ব্রণ। অথচ প্রথম যেদিন ওকে দেখেছিলাম, মনে হয়েছিল ছোট্ট চঞ্চল একটা ধবধবে পরি!
ভ্যাপসা গরম বাতাসগুলো হঠাৎ ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। আমার চুল উড়ছে উদ্ভ্রান্তের মতো। আকাশে ফালি ফালি করে কাটা মেঘ, শরতের মেঘ। তবে আমি জানি এই মেঘ বৃষ্টি নামাতে পারবে না। রাস্তার শেষান্তের দিকে চোখ ফেরালাম। সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমি আমার স্মৃতির গভীরে, বেশ অনেকটা অতীতে হারিয়ে যাচ্ছি!
দুই.
মেয়েটার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় আজ থেকে ১১ বছর আগে, ফেসবুকেই। হ্যাঁ, এই জনপ্রিয় স্যোশাল সাইটেই ওর সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল। ওর পুরো নাম পূর্বা রায়। ওকে আমি অনেক নামে ডাকতাম— পূর্বা, পিচ্চি, বোনটি, ছোটদি, চশ্মিশ, টিঁয়েপাখি, আরও কত কত নাম, ভুলে গেছি এখন। তবে সবচেয়ে বেশি ডাকতাম ‘বিষাণ্ণিতা’। এটা ওর নিক নেইম সেট করা ছিল মেসেঞ্জারে। পূর্বাও আমাকে অনেক নামে ডাকত— রাজু’দা, বড়’দা, ভাইটু, মাস্টার সাহেব, ড়-কবি, খরগোশ, বাকিগুলো এখন আর মনে নেই। ওর ‘বিষাণ্ণিতা’ নামটার পেছনের কারণ হলো, ওর কারণে অকারণে মন খারাপ হতো, প্রায়ই হতাশ হয়ে থাকত ও।
আমি তখন কলেজে প্রথম বর্ষ। আর পূর্বা মোটে জেএসসিতে এ+ পেয়ে বাবার কাছ থেকে একটা ফোন উপহার পেয়েছে। কীভাবে কীভাবে যেন একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছিল। কিন্তু খোলার পর ফেসবুকের আগামাথা কিছুই বুঝত না! আমার লেখা একটা কবিতা পড়ে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছিল আমাকে। আমার তখন একটু আধটু কবিতাচর্চা চলত। আনমনে অ্যাক্সেপ্ট করেছিলাম ওর রিকোয়েস্ট। তখন হয়তো ভাবতেও পারিনি, এই মেয়েটা আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবে।
প্রথম প্রথম সংকোচ নিয়ে এটা-ওটা প্রশ্ন করত ও। আমিও বিরক্ত না হয়ে উৎসাহ নিয়ে ওকে উত্তর করতাম। আমাদের আলাপনের বিশাল অংশ জুড়ে ছিল লেখালেখি। সম্ভবত আমাদের প্রথম কথাটা ছিল ফ্ল্যাশ ফিকশন নিয়ে। ও একটা ফ্ল্যাশ ফিকশন লিখে আমাকে পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিল হয়েছে কিনা। আমি তার কাঁচাহাতের লেখা পড়ে নিরুৎসাহিত করিনি, বরং তাকে ফ্ল্যাশ ফিকশন বিষয়টা বিশদভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। লেখালেখি জিনিসটা হাতে-কলমে শেখার কিছু নয়। কিন্তু ওকে আমার লেখালেখির খুঁটিনাটি সব শিক্ষকের মতো শেখাতে হতো। তখন থেকেই আমি হয়ে উঠলাম মাস্টার সাহেব।
শিক্ষক-ছাত্রীর গণ্ডি পেরিয়ে, সম্পর্কটায় কবে যে ভাতৃত্বের শেকড় গজিয়েছে, কেউই খেয়াল করতে পারিনি। আমি প্রগাঢ় বিষ্ময়ে একদিন আবিষ্কার করেছিলাম, ভিন্ন মায়ের পেটে জন্মেও সহোদর-সহোদরা হওয়া যায়। বোনহীন আমি পূর্বার প্রতি রক্তের টান অনুভব করতাম; যেন ও আমার মায়ের পেটের ছোটো ভাইটার মতনই আমার মায়ের পেটের বোন। আমরা দুজন পুরো ফেসবুক জুড়ে পাগলামির জন্য অনেক পরিচিত ছিলাম। ধর্মের প্রাচীর ভেঙে রাগ-অভিমান-খুনসুঁটি-ভালোবাসা সব নিয়ে অশ্বথের মতো গেড়ে বসেছিল সম্পর্কটা। আমি ফর্মালিটি দেখিয়ে ফেসবুকে কোনো মেয়েকে আপু ডাকলেও ভীষণ রেগে যেত পূর্বা! রেগেমেগে ব্লক দিতো কিংবা আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে চলে যেত। এরপর আমায় ওকে অনেক মেসেজ-কল দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেসবুকে আনতে হতো। ওর সাফ সাফ কথা ছিল— ‘আমার বড়’দার ভাগ কাউকে দিমু না! কেউ তোকে ভাই ডাকলে খবর আছে!’
হায়, আমার টিঁয়েপাখি বোনটা! এখন তোর রাজু’দার কত শত বোন! শুধু তুই নেই তার জীবনে, আর নেই অকৃত্রিম ভালোবাসাগুলো!
আমার অবশ্য পূর্বার মতো অত বাচ্চামো স্বভাব ছিল না! তবে সিরিয়াস কিছু বিষয় হলে আমিও রাগ অভিমান করতাম। ও নানাভাবে আমার রাগ ভাঙাতো। মনে আছে, ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২৫ ডিসেম্বর। সালটা সম্ভব ২০১৩। পড়ন্ত বিকেলের আবছা রোদের আলোয়, আমাদের মুখোমুখি দেখা হয়। একটা ছোট্ট পরি, তার ডানা খুলে রেখে ভাইয়ের জন্য হাতে এক বাক্স বিরিয়ানি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি বিরিয়ানি খেতে পছন্দ করি বলে, নিজ হাতে রান্না করেছিল ও। কেমন যেন মা মা স্বাদ ছিল ওই বিরিয়ানিতে। আমি এখন প্রায়শ বিরিয়ানি খাই, অথচ সেই স্বাদ আর কখনো পাওয়া হয় না! সেদিন আমাদের খুব বেশি কথা হয়নি। শুধু বিরিয়ানি আর বই হাত বদল করে চলে এসেছিলাম দুজন! আমি আবার ছোটোবেলা থেকেই কাউকে উপহার হিসেবে বই ছাড়া অন্য কিছু দিতাম না!
এরপর সময় গড়িয়েছে। সময়ের আঁলপথ ধরে এগিয়েছে আমার আর পূর্বার ভাই-বোন সম্পর্কটাও। এর মাঝে অনেক ঘাত প্রতিঘাত ছিল, অনেক গল্প ছিল। সেই গল্পগুলো আমি আর আজ মনে করতে চাই না। কিছু গল্প ওপারে উনার কাছেই জমা থাকা ভালো। নাহলে অযথা মাঝে মাঝে স্মৃতির রক্তক্ষরণ হয়। তখন সহ্য করা ভীষণ কষ্টকর হয়ে ওঠে।
যাই হোক, দুই বছর পর আমি ইন্টার পাস করে ভার্সিটিতে চান্স পাই। পূর্বাও স্কুল পাশ করে কলেজে ওঠে। সেবারও গোল্ডেন পেয়েছিল ও। তারপর একদিন সেই অনাকাঙখিত সময়টা আসে! হুট করে পূর্বার বাবা মারা গেলেন। কাকু মারা যাবার পর ভীষণ বিপাকে পরে গেল পূর্বার পরিবার। এরপরেও কষ্ট করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল পূর্বা। কিন্তু ঝামেলা বাঁধালো ওর মামা। হুট করে কিছু বুঝে উঠার আগেই ওকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো ৩১ বছর বয়েসি এক জাত বাক্ষ্মণের সাথে! পূর্বার ওই সময়ের কান্না বিজড়িত কণ্ঠের বিপরীতে আমি ছিলাম নিরুত্তাপ, অসহায়, বোধশক্তিহীন আর বোবা!
পড়ার ইতি টেনে আমার বোনটা সংসারি হলো। আমার সাথে ওর যোগাযোগের মাত্রা কিছুটা কমে গেল। পরে জানলাম, ওর সংসারটা মোটেও সুখের ছিল না! চোখ বুজে, মাটি কামড়ে, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছিল আমার টিঁয়েপাখিটা। এদিকে ক্যাম্পাসে এসে আমার পরিচয় হলো জাফরিনের সাথে! প্রথমে বন্ধুত্ব, এরপর ধীরে ধীরে প্রণয়ে গড়ালো আমাদের ব্যাপারটা। জাফরিনের সাথে সম্পর্কের পর আমি আবিষ্কার করলাম, জাফরিন আর পূর্বার মধ্যে কীসের যেন সুক্ষ্ম দ্বন্দ্ব। কিন্তু এই সমীকরণের কোনো মানে ছিল না আমার কাছে। আমি দুজনকে প্রায়ই বুঝাতাম, তারা দুজন দুই মেরু আমার কাছে! একজন আমার বোন, একজন আমার প্রেমিকা! তবুও হয়তো কোথাও কমিউনিকেশন গ্যাপ থেকে গেছিল একটা। সেটা আর পিছু ছাড়ল না।
এভাবে মানসিক দ্বন্দ্ব আর সম্পর্কের টানাপোড়ন নিয়ে আরও একটা বছর কেটে গেল। পূর্বার সাংসারিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলেও, তার কোল জুড়ে একটা ফুটফুটে দেবশিশু আসলো। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে, বই আর বাবুর জন্য ড্রেস নিয়ে ওদের দেখতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে বাঁধলো আরেক বিপত্তি। পূর্বার স্বামী তার বিধর্মী ভাই দেখে ভীষণ চটে গেলেন! তারপর…..
আমার মাঝে মাঝে ওপারের উনার প্রতি প্রচণ্ড রাগ হয়! তাঁকে একজন পাষণ্ড খেলোয়াড় মনে হতে থাকে। সে আমাদের সবার জীবনকে নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলে মজা পায়। কেন হে, কেন?
তারপর, একদিন আমি আর পূর্বা আকাশসম দূরত্ব আবিষ্কার করি। পূর্বার সাথে আমার শেষ কথা ছিল, ‘দা’ভাই আমি কি এই নরক থেকে মুক্তি পাব না?’ আমি নিরুত্তর ছিলাম। কারণ আমার কিছুর করার ছিল না। আমার হাত-পা অনেক জায়গায় বাঁধা ছিল। পারিবারিক অবস্থান, সামাজিক অবস্থান, ধর্ম বিশ্বাসের জায়গা ও নিজের প্রণয়ের সম্পর্কের মাঝখানে একটা অযাচিত গড়ে উঠা ‘ভাই-বোন’ সম্পর্ক অনেকটা তাসের ঘর হয়ে উঠেছিল তখন।
তিন.
পূর্বার সাথে যোগাযোগ বন্ধের পর আমাকে নামতে হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা যুদ্ধে। পরিবারের অমতে জাফরিনকে বিয়ে করি। শহরের একটা ব্যস্ত এলাকায় ছয় তলা বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় এক রুমের সাবলেটে শুরু হয় আমার আর জাফরিনের ছোট্ট সংসার। ঘরের আসবাবপত্র বলতে ছিল— একটা তোষক, দুটো বালিশ, তিনটে পাতিল, একটা গ্লাস আর একটা জগ। সারাদিন ক্লাস করে, বিকেলের ম্লান আলোয় বাড়ি ফিরি দুজন। জাফরিন একটু পরেই রান্না করতে লেগে যায়, আমিও সাহায্য করি ওকে এটা ওটা করে। আমাদের সাদামাটা অনাড়ম্বর জীবনে যে জিনিসটার কমতি ছিল না, সেটা হলো ‘ভালোবাসা’! প্রবাদ আছে— অভাবে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। অথচ আমি দেখেছি, অভাবে আমাদের ভালোবাসা গাঢ় হয়েছে, গভীর হয়েছে আরও। আমরা একবেলা খেয়ে একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে দিন পার করেছি! টাকা না থাকায়, কয়েক মাইল পায়ে হেঁটে ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করেছি! দুটো কাপড় আর এক জোড়া জুতো দিয়ে পার করেছি মাসের পর মাস।
এমন না আমাদের একদম ঝগড়াঝাঁটি হতো না! হতো! তাও আবার যেনতেন না, তীব্রতর ঝগড়া হতো। এমনও হয়েছে দুজনে রীতিমতো কুস্তি খেলেছি। দিনে হাজার বার বলেছি, তোমার সাথে আর সংসার সম্ভব না! কিন্তু… রেগেমেগে একপাশ হয়ে শোয়া জাফরিন ঘুমের মধ্যে আমায় জড়িয়ে ধরেছে, আমিও তাকে কাছে টেনে নিয়েছি। ব্যস, সকালে উঠে সেই তুমুল ঝগড়াগুলোর সমাপ্তি। মাঝে আমার টিউশনি হারিয়ে খুব বিপাকে পড়ে গিয়েছিলাম। বেশ কদিন উপোসও কাটিয়েছি দুজন। তবুও আমরা দুজন দুজনকে কখনো ছাড়তে পারিনি!
সংসার আর পড়াশোনার চাপাচাপির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি আমার আমিত্বকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমার অতীত আর ভবিষ্যত! আমার বই লেখার শখ, জোছনা রাতে জোনাকি ধরার শখ, কৃষ্ণখালী নদী আর স্মৃতিভর্তি কিছু নিকটবর্তী মুখ; কিছুই মনে ছিল না আমার। জীবন নামক সাগরের জলে সবকিছু পাশ কেটে যাচ্ছিল, আমি দৃষ্টিপাত না করে দূরে তীরের সন্ধানে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
তারপর একদিন, এক কুয়াশামাখা ভোরে ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত, আমার জীবনের মোড় অনেকটা ঘুরিয়ে দিলো। মাত্র ৯৯৯ টাকা মূলধন নিয়ে আমি অনলাইনে একটা বিজনেস শুরু করেছিলাম। অবশ্য শুরুর দিনগুলো এতই বাজে ছিল যে, ঠিক যেন মধ্যরাতের দুঃস্বপ্ন। একের পর এক হারতে হারতে আমি নিজের ভেতরই ভেঙে যাচ্ছিলাম। যেটাই করতে যাচ্ছিলাম, সবগুলো ঠিক উল্টো ঘটছিল! এমন সময় আমার খুঁটি হয়েছিল জাফরিন। আমাকে স্থির ধরে রেখে সাহস জুগিয়েছিল ও। প্রথম সফলতাটা আসতে প্রায় ১ বছর ৩ মাস কেটে গেছে। এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি। আমার লক্ষ্যের চেয়ে বেশি উঁচুতে পৌঁছেছিল কাজটা।
এদিকে পূর্বার জীবনে তখন ঝড় বইছে। আমার সাথে ঠিক এক বছর পর পূর্বার আবার কথা হলো। এক সংগ্রামী নারী তার দুর্বিষহ জীবনের গল্প লিখল আমার মেসেজ বক্সে। আমি অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলাম। তারপর একদিন খোঁজ পেলাম, পূর্বা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাঙালি সমাজের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় সংস্কারের বিরুদ্ধে! সব মায়া ছিন্ন করে সে তার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছে! কিন্তু তার দুর্ভাগ্য তখনো শেষ হয়নি! কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ওর বাচ্চাকে নিয়ে নেওয়া হলো! স্বামী সংসার ছেড়ে বাপের বাড়িতে নতুন যুদ্ধ শুরু হলো তার। বাবাহীন বাড়িতে লাঞ্ছনা, উপহাস সাথে নিয়েই বাঁচতে শুরু করল ও! আমি ভাইয়ের অবস্থান থেকে ওকে বলেছিলাম, আমার কাছে চলে আসতে, এমন কি জাফরিনও রাজি ছিল। কিন্তু তীব্র আত্মসম্মানবোধের কারণে পূর্বা এলো না।
এরপর আমাদের দূরত্ব আবারও বেড়েছে, কমানো হয়নি আর। পূর্বা, কেমন যেন অন্য মানুষ হয়ে গেল। ওকে যেন আমি আর চিনি না। ওর আইডি দেখলে মনে হয় আমার সাথে কখনো ওর পরিচয় হয়নি! আমরা যে কতটা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছিল। তারপর পেছনে সরতে সরতে এক সময় পুরোনো স্মৃতির ফ্রেমে তলিয়ে গেল পূর্বা, আমার একমাত্র বোন; আমার ‘বিষাণ্ণিতা’!
চার.
মনে পড়েছে। সকালে এখানে এসেছিলাম একটা জিন ব্যাংক থেকে কিছু প্ল্যান্ট জিনের স্যাম্পল নিতে। বিকেলে একটা স্থানীয় স্কুলের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হবে। মাঝেপথে পূর্বার সাথে দেখা হলো। আমি এতদিন পর ওকে দেখে ‘থ’ মেরে গেছি। মাথার ভেতর অনেকগুলো প্রশ্ন দলা পাকাচ্ছিল—
‘কেমন আছিস টিঁয়েপাখি? এতদিন পর কোত্থেকে? কই আছিস, কী করছিস এখন? আমাকে চিনেছিস? তোর চেহারাটা এমন হয়েছে কেন? খাস না? ঘুমাসও না? তোর বাচ্চার কী খবর?’ সবগুলো প্রশ্নই আমার গলার কাছে আটকে গেল; একটাও বেরোতে পারল না! শুধু ফ্যাসফ্যাসে স্বরে ছোট্ট করে বের হলো, ‘পিচ্চি তুই?’
ও প্রতিউত্তরে— ‘দা’ভাই ভালো থাকিস। আসি।’ নির্লিপ্তভাবে এটুক বলে, পিচ ঢালা রাস্তা যেখানে দিগন্ত ছুঁয়েছে সেখানে হারিয়ে গেল। আমি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলাম। কথাটা বলার সময় কি ওর ঠোঁট কাঁপছিল? চোখের কোনায় জল জমছিল? ঠিক মনে পড়ছে না এখন!
আমি উদাসীন মনে হাঁটছি। আশপাশ সম্পর্কে খুব একটা খেয়াল নেই আমার। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব। মাথার ভেতর শব্দরা জট পাকাচ্ছে। তারপর…..
পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম:
‘প্রখ্যাত জিন গবেষক ও জীবপ্রযুক্তিবিদ ড. রাজু আহমেদকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।’
এদিকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে একটি উগ্রপন্থী ধর্মীয় সংগঠন। তাদের দাবি রাজু আহমেদের গবেষণা প্রবন্ধ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এনেছে!
পাঁচ.
আমি জানি আমার অনুভূতি কখনো কারও জানা হবে না। আমার বিদায়ের সাথে সাথে এক জীবনের দীর্ঘ এক খণ্ড খণ্ড গল্প হারিয়ে গেছে। হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করছে, আচ্ছা জাফরিন কি ভালো থাকতে পারবে একা একা? পূর্বা কি আমার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছে? জানতে পারলে কি খুব মন খারাপ হবে বিষাণ্ণিতাটার? নাকি আমি নিতান্তই ফেলনা বিষয় হয়ে যাব সবার জীবনে?
[কীওয়ার্ডস:
বিষাণ্ণিতা | আবুল হাসনাত বাঁধন
বিষাণ্ণিতা : আবুল হাসনাত বাঁধন
বিষাণ্ণিতা – আবুল হাসনাত বাঁধন
ছোটোগল্প | বিষাণ্ণিতা
আবুল হাসনাত বাঁধনের ছোটোগল্প | বিষাণ্ণিতা
আবুল হাসনাত বাঁধনের ছোটোগল্প : বিষাণ্ণিতা
আবুল হাসনাত বাঁধনের ছোটোগল্প – বিষাণ্ণিতা
ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]
Pingback: ভান | গোলাম রাব্বি রাকিবের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: একটি ভুলের গল্প | গল্পীয়ান