অত্যয় | আবুল হাসনাত বাঁধন

অত্যয় | আবুল হাসনাত বাঁধন

অত্যয় | আবুল হাসনাত বাঁধন

গল্পটা একটা মেয়ের। নাম তানিয়া। অন্য সাধারণ আট-দশটা বাঙালি মেয়ের মতোই ছিল তার জীবন। কিন্তু বর্তমানে সে, সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আটকানো এক অসতী নারী। এক বিশ্বাসঘাতিকা স্ত্রী, এক নষ্টমতি মা। রিপুর কলঙ্ক গায়ে মেখে ব্যস্ত শহরের ধুলো উড়া ফুটপাতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পায়ে নিরুদ্দেশ হেঁটে চলেছে সে।

এই গল্পের শুরুটা আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে। যে বয়সটা ছিল দস্যিপনা করে ঘর মাতিয়ে রাখার বয়স, ছিল হাসির খলখলানিতে সুরের মূর্ছনা ছড়ানোর বয়স; সেই বয়সটাতেই বাবা তাকে প্রায় দ্বিগুন বয়সী এক লোকের সাথে বিয়ে দিয়ে সংসারের শৃঙ্খলে বন্দী করে দিলো। সবে মাত্র এসএসসি পাস করেছিল সে। তার আর মুক্ত আকাশ দেখার সময় এলো না, দেখা হলো জীবনের দৃশ্যপট। বিয়ের সময় তাকে পড়াশোনা করতে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর পড়তে দিলো না শ্বশুরবাড়ির লোকেরা।

⏩ আরও পড়ুন: অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

তবুও সংসারকে বুকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিল তানিয়া। কিন্তু খেয়াল করে দেখল, তার স্বপ্নের সাথে দ্বিগুন বয়স্ক স্বামীর কোনোই মিল নেই। একরোখা একটা লোক, কারণে অকারণে চিৎকার চেঁচামেচি করে ওর ওপর। বইপড়ার অভ্যাস ছিল তানিয়ার। একদিন তো সব বই ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো সেই লোকটা। কেউ একজন বোধ হয় ঠিকই বলেছিল, ‘একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর বাস করেও ভালোবাসাটা হয় না!’ ওদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমনই ছিল। নিজেকে চার দেয়ালে বন্দী একজন ধর্ষিতা মনো হতো তানিয়ার।

সময়ের পরিক্রমায় তানিয়ার কোল জুড়ে একটা ছেলেও আসলো। যদিও স্বামীর সাথে দেহ কিংবা মন কিছুরই মিল ছিল না তার। তবুও অনেকটা একপাক্ষিকভাবেই তার সন্তান আসলো। কিন্তু সন্তান পেয়ে কিছুটা দুঃখ ভোলার চেষ্টা করল তানিয়া। সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শুরু করল।

তারপর কয়েকবছর কেটে যায় এভাবে।

ছেলেকে স্কুলে দেবার পর, ঘর থেকে বের হবার সুযোগ পায় তানিয়া। ছেলেকে স্কুলে আনা নেওয়ার সময়টাই যেন স্বর্গীয় স্পর্শ। বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে, আকাশের বিস্তৃতিতে হারিয়ে যেতে পারে। এই সুবাধে ফোনও পেল ব্যবহারের জন্য। একদিন কীভাবে কীভাবে জানি অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে ফেসবুকে। প্রথম প্রথম কিছুই বুঝত না। ধীরে ধীরে ফেসবুকের সবকিছুই আয়ত্বে চলে আসে তার।

তার বন্দীত্বের অসহ্য জীবনের মধ্যে ফেসবুক একটা নতুন দ্বার উন্মোচন করল। ফেসবুকে এসে প্রশান্তি লাভ করে সে। তার একাকিত্ব বোধ কেটে যেতে থাকে, ফেসবুকে দেশ বিদেশের কত লোক যুক্ত আছে তার সাথে। শুরু শুরুতে নিউজফিড স্ক্রল করে দিন কেটে যেত তানিয়ার। তারপর আস্তে আস্তে চ্যাটিং শুরু হয় অনেকের সাথে। ছোটো বড়ো, ছেলে মেয়ে অনেকের সাথেই।

⏩ আরও পড়ুন: সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

তারপর,
ফেসবুকেই একদিন পরিচয় হয় শামীম এর সাথে। ফেসবুকে লেখালেখি করে শামীম। ওর প্রতিটা গল্প-কবিতা মন দিয়ে পড়ে তানিয়া। লেখা পড়ে মুগ্ধতায় ছেয়ে যায় ওর মন। লোকটার লেখায় হয়তো জাদু আছে। সংকোচবোধের কারণে কখনো নক করা হয়নি শামীমকে। একদিন শামীম নিজেই নক করে তানিয়াকে। তানিয়া সেদিন প্রচণ্ড খুশি। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।

ছোটোখাটো আলাপন থেকে সম্পর্কটা গভীর হওয়া শুরু। এরপর রাত-দিন চ্যাটিং চলতে থাকে। অতিরিক্ত ফোন চালানোর কারণে দু-একবার স্বামীর হাতে মারও খায় তানিয়া। স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ আরও বেড়ে যায় ওর। প্রশান্তি খুঁজতে ছুটে যায় ফেসবুকে শামীমের কাছে। একপর্যায়ে মন দেওয়া নেওয়া করে দুজন। যদিও শামীম জানতো তানিয়া বিবাহিতা ও এক সন্তানের জননী।

ফেসবুকে দুজনের পরকীয়া প্রেম চলতে থাকে। একদিন শামীম ইনবক্সে তানিয়ার ন্যুড পিক চায়। তানিয়া প্রথমে ইতস্তত করে, পরে ওয়াশরুমে গিয়ে ন্যুড পিক দিয়ে দেয় ওর। তাদের সম্পর্টা ধীরে ধীরে মনের দিক থেকে দেহের দিকে এগুলোতে থাকে। শামীম একপর্যায়ে ভিডিয়ো সেক্সের অফার করে। তানিয়াও রাজী হয়ে যায়। কারণ স্বামীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্কও ঠিক ছিল না।

এরপর প্রায়শ হোয়াটসএপ, ইমো, মেসেঞ্জারে ভিডিয়ো সেক্স চলতে থাকে শামীম আর তানিয়ার। বেশ কিছুদিন পর শামীম বলে, সে তানিয়ার সাথে দেখা করতে চায়। তানিয়া তাকে ছেলের স্কুলে আসতে বলে।

যথারীতি শামীম তানিয়ার ছেলের স্কুলে উপস্থিত হয় একদিন। ছেলেকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিয়ে, শামীমের সাথে বের হয় তানিয়া। এরপর একটা নির্জন বাড়িতে যায় দুজন। ওই বাড়িতেই নিজের সর্বস্ব শামীমকে বিলিয়ে দেয় তানিয়া। শামীমের সাথে মিলনে পরম তৃপ্তি লাভ করে সে। যে সুখটা কখনো তার স্বামী দেয়নি তাকে।

⏩ আরও পড়ুন: এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন

এরপর আরও বেশ কয়েক বার একই ভাবেই ওই বাড়িতে মিলিত হয় ওরা দুজন। কিছুদিন পর হঠাৎ শামীম যোগাযোগ অফ করে দেয় তানিয়ার সাথে। নাম্বার বন্ধ। ফেসবুকে ব্লক দিয়ে দেয় তাকে। তানিয়া হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে শামীমকে। কিন্তু পায় না। কয়েকদিন পর তানিয়া দেখে, ফেসবুকের একটা জনপ্রিয় পাব্লিক গ্রুপে একটা ভিডিয়ো আপ্লোড হয়েছে। আপ্লোড হওয়ার পরেই খুব ভাইরাল হয়ে যায় ভিডিয়োটা। তানিয়া ভিডিয়োটা অন করে দেখে, ওর আর শামীমেরই সেক্স ভিডিয়ো সেটা। তানিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে, একটা শীতল স্রোত পিঠ বেয়ে নেমে যায় ওর।

ঠিক সেই মুহূর্তেই টিভির স্ক্রিনে চোখ যায় ওর। টিভিতে সংবাদ চলছিল। স্ক্রিনে শামীম। পুলিশ আটক করেছে তাকে। সংবাদের তথ্য থেকে জানা গেল তার আসল নাম রবিন আহমেদ। দুবছর আগে বউয়ের সাথে ডিভোর্স হয় তার। শামীম সাখওয়াত নামে ফেসবুকে লেখালেখি করত। মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করত এবং গোপনে ভিডিয়ো করত সেগুলো। এরপর বিভিন্ন সাইটে প্রকাশ করে টাকা আয় করত সে। তার প্রধান শিকার ছিল, স্বামীর সাথে দাম্পত্য কলহে ভোগা বিবাহিত নারীরা।

তানিয়ার ছেলেটা তখন তখন ঘুমোচ্ছিল। ছেলের মাথায় একবার হাত বুলাতে চেয়েও বুলালো না সে। নোংরা হাতে ছেলেকে আর স্পর্শ করতে চাইল না। নিজের প্রতি লজ্জায়, ঘৃণায় তানিয়ার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে আসলো। সে ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। রাস্তায় নামল।

তারপর থেকে ফুটপাত ধরে হাঁটছে, গন্তব্য জানা নেই।

‘অত্যয়’ | © আবুল হাসনাত বাঁধন

রচনাকাল: (০২/০৮/২০১৭)

স্থান: পটিয়া, চট্টগ্রাম।


প্রিয় পাঠক, ‘অত্যয়’ – গল্পটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ‘অত্যয়’ গল্পটি আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা! ‘অত্যয়’ এর মতন আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে গল্পীয়ানে চোখ রাখুন।

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: