আমি ও বই : আত্মিক প্রেম | আবুল হাসনাত বাঁধন
আমার যত বিলাসিতা বই নিয়েই। আমি কখনো কোনো রেস্টুরেন্টে খাই না, কোথাও বেড়াতে গিয়ে টাকা উড়াই না। আমার ৯০% টাকাই খরচ হয় বই কিনতে। উপহার পাওয়া কয়েকটা বাদে বুক শেলফের পুরোটা সংগ্রহই নিজের কেনা।
আমাকে কেউ টাকা দিলে, অযথা নষ্ট না করে বই কিনে খাই। পরীক্ষার সময়, নানা উপলক্ষ্যে আন্টি-মামারা টাকা দিলে ওগুলো সব বাতিঘরের কাউন্টারেই চলে যায়। টিউশনির বেতন পেয়েই আমি পরদিন বাতিঘরে ছুটে যাই। আম্মা কোচিং এ যেতে ২০/২৫ টাকা ভাড়া দেয়। আমি রিকশা না নিয়ে কোতোয়ালি পর্যন্ত হেঁটেই যাই। হেঁটে হেঁটে মানুষ দেখতে আমার ভালোই লাগে। এরপর লোকাল বাস কিংবা টেম্পুতে চড়ে বসি। প্রতিদিন ১০/১৫ টাকা বেঁচে যায়। মাস শেষে দুটো বই।
⏩ আরও পড়ুন: অষ্টাদশী পতিতা ও একটি নষ্ট গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন
বাহ্যিক কোনো চাকচিক্যে আমার আগ্রহ নেই। খুবই অনাড়ম্বর জীবনযাপন করি। প্রতি মাসে মাসে শার্ট প্যান্ট কিনি না। আমার চশমাটাও ৩ বছরের পুরোনো। শুধুমাত্র ইদেই কাপড় কেনা হয়। এই ইদে কেনাও হয়নি। এসবের বদলে আমি বই কিনে পড়ি। আমার ভেতরটাকে স্বর্ণের মতো চকচকে করে তুলি।
চিকেন ফ্রাই এর ঘ্রাণের চেয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আমার অধিক প্রিয়। রেস্টুরেন্টের মুখোরোচক খাবারগুলোর চেয়ে বই-ই আমার কাছে সুখাদ্য। আমার নতুন বইয়ের পাতায় নাক ডুবিয়ে রাখতে ভালো লাগে। বিশ্বাস করুন, পৃথিবীতে কোনো ফুলেরও এত মাতাল করা সৌরভ নেই। বইয়ের পেলব প্রচ্ছদে হাতের তালু ঘষতেও আমার ভালো লাগে। মনে হয় মলাটের রঙগুলো মেখে যাচ্ছে আমার হাতে। বইয়ের ত্বক ভীষণ কোমল, বাচ্চাদের মতো। আমি সেই কোমলতার স্পর্শ নিই। বইয়ের মতো আর কোনো বন্ধু নেই আমার। বই-ই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু!
আমি যখন কোনো নতুন বই পড়ি, তখন নতুন একটা গ্রহে হারিয়ে যায়। গল্পের গ্রহ, কাহিনির গ্রহ। বইয়ের চরিত্রগুলো জ্যান্তব হয়ে ওঠে সেথায়। ইচ্ছে করলেই আমি তাদের সাথে মিশে যেতে পারি। তারা অতি আপনজন আমার। আমিও একেকটা কাহিনির অংশ। কারণ গল্পগুলো উঠে আসে আমাদের জীবন থেকেই। চরিত্রগুলো প্রায়শ ঘুরোঘুরি করে আমার চারপাশে। আমি প্রেমেও পড়ি, নিখাদ ও বিশুদ্ধতম প্রেম। চারুলতা, মৃণালিনী, কপালকুণ্ডলা, তরুলতা, রূপা আরও কত কত প্রেমিকা আমার। মাঝরাতের তীব্র জোছনায় আমিও হিমু হবার প্রয়াস চালাই। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে, নগ্ন পায়ে আমি নাগরিক ফুটপাত ধরে হেঁটে চলি। চাঁদের সফেদ আলো আর রাস্তার ধারের সোডিয়ামের হলদে আলো একত্রিত হয়ে লেপ্টে যায় আমার গায়ে। আমি আকাশ দেখি। আকাশে তারার বদলে ঝুলে থাকে অসংখ্য বই।
⏩ আরও পড়ুন: সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন
আমি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মেম্বার। প্রতি সপ্তাহেই চাইলে নতুন বই এনে ফ্রি ফ্রি পড়তে পারি। কিন্তু পড়ি না। কারণ, বইগুলার অবস্থা এখন মুমূর্ষ। সরকারি মাল হওয়ায়, বইগুলো অসংখ্য ছাগল কর্তৃক ধর্ষিত। এসব বইয়ে নাক ডুবানো যায় না দুর্গন্ধের কারণে। একটা বই আনলেই মাসের পর মাস টেবিলে পড়ে থাকে অনাদরে।
আমি বই পাশে নিয়ে ঘুমাই, বই স্পর্শ করেই জেগে উঠি। তবে এটাও জানি, জাগতিক নিয়মে একদিন আমি আর ঘুম থেকে উঠতে পারব না। সেই দিনটার আগেই কিছু বই দিয়ে যেতে চাই পৃথিবীকে। বইয়ের মাঝেই বেঁচে থাকব আমি।
সেদিন আকাশ গুমোট মেঘে ছেয়ে যাবে। খানিক পরপর বাজের শব্দ হবে। বিষণ্ণ সায়াহ্নবেলায় নামবে ক্ষুধার্ত বৃষ্টি। ডানাভাঙা একলা চড়ুই, ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁকে যুদ্ধ করবে ঝড়ের বিরুদ্ধে। আমার হাতে থাকবে একটা গল্প, উপন্যাস কিংবা কবিতার বই। আমি জানি বইটা সম্পূর্ণ পড়ে শেষ করার আগেই আমার অন্তিম যাত্রা শুরু হবে মহাশূন্যের দিকে!
আমি ও বই : আত্মিক প্রেম
লিখেছেন: আবুল হাসনাত বাঁধন
রচনাকাল: (২২/০৭/১৬)
স্থান: পাথরঘাটা, চট্টগ্রাম।
⏩ আরও পড়ুন: অত্যয় | আবুল হাসনাত বাঁধন
প্রিয় পাঠক, ‘আমি ও বই : আত্মিক প্রেম’ – প্রবন্ধটি ভালো লাগলে পরিচিত বন্ধুদের কাছে শেয়ার করুন। আবুল হাসনাত বাঁধন এর লেখা ‘আমি ও বই : আত্মিক প্রেম’ এর মতন আরও নতুন নতুন প্রবন্ধ – গল্প – কবিতা পড়তে চাইলে গল্পীয়ানে চোখ রাখুন।