আলেয়া [ দ্বিতীয় পর্ব ]

আলেয়া [দ্বিতীয় পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

বাইরে কারও কর্কশ গলার স্বরে ঘুম ভাঙল আরিফের। এই সাঁঝ সকালে তার বাড়িতে কে! ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। দরজা খুলতেই সকালের রক্তিম সূর্যের একফালি আলো এসে তার চোখে পড়ে। বাইরে পাখির কিচির মিচির। ঘুম চোখে দেখতে পায় এক মধ্যবয়স্ক লোক। পরনে তার লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। আরিফ লোকটিকে আগে দেখেছে বলে তার মনে পড়ে না।

‘কাকে চাই?’
‘আরিফ সাহেব আছেন?’
‘জি, আমিই আরিফ।’
‘আপনার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। আমি ভেতরে আসি?’
‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো!’
আরিফ কথাটা শেষ করার আগেই লোকটা ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে ঢুকে সোফায় বেশ আরাম করে বসে গেল। এদিকে ততক্ষণে লি জিকির ঘুম ভেঙে গেছে। বিছানায় বসেই একটা লোকের কণ্ঠ শুনতে পায় সে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না তার।

‘বাড়িতে কি আপনি একাই থাকেন?’
‘জি না। আপনি কে সেটা আগে বলুন।’
লোকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘আমি সুজন মিয়া। সবাই সুজন বলেই ডাকে।’
‘সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আমার কাছে কেন?’
‘সব বলছি। আমাকে একজন পাঠিয়েছে। এই তার কার্ড। আমার ছেলের একটা কাজ দরকার। ও আপনার লাইনেই পড়েছে। ও আপনার কাজে সাহায্য করতে পারবে!’
কার্ডটা এগিয়ে নিতে নিতে আরিফ বলে, ‘তা ঠিক আছে। কিন্তু এখন তো আমার এই রকম লোক লাগবে না।’
‘আপনি কার্ডটা দেখুন। পেছনে লেখা আছে।’

আরিফ কার্ডটা দেখে। পেছনে আরিফের মামা মিরাজের সিগনেচারসহ লেখা- ‘আরু, ছেলেটার বেতন নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ওটা আমি দেবো। তুমি শুধু ছেলেটাকে নিজের কাছে রাখো। ইতি তোমার ছোট মামা, মিরাজ।’

‘আচ্ছা। মামা যেহেতু বলছে তখন আর কী! আপনার ছেলে?’
‘ও গেটের কাছে। আমি ডেকে আনছি।’
লোকটা সোফা ছেড়ে উঠে ছেলেকে ডাকতে গেল। বেশ স্বস্তি পেল সুজন মিয়া। মনে মনে ভাবতে লাগল,’যাক কাজ হলো তবে।’

লি জিকি বেডরুম থেকে বেড়িয়ে আসলো। চোখ কছলাতে কছলাতে আরিফকে প্রশ্ন করল, ‘কে এলো এই সকালবেলা?’
‘পরে বলছি তুমি ভেতরে যাও। রৌদ্রা ওঠছে?’
‘না ওঠেনি।’

লি জিকি আবার বিছানায় গিয়ে ঘুমে এলিয়ে পড়ে। লোকটা সাথে করে তেইশ-চব্বিশ বছরের এক যুবককে সাথে নিয়ে আসে। দেখতে বেশ সুদর্শন। আরিফ বুঝতে পারে না একে দিয়ে কী হবে! তবুও কথায় আছে, আগে দর্শনধারী, পরে গুনবিচারী। তাই দর্শনে আপাতত ছেলেটাকে ভালোই লেগেছে। কিছুটা ভদ্র ও বাধ্যগত! ছেলেটা আরিফকে সালাম করল। সুজন মিয়া যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

‘আমার আবার গাড়ি ধরতে হবে। আমি এখুনি বের হবো আরিফ সাহেব।’
‘সে কী! বিকেলবেলা যাবেন।’
‘না না। সে আর এক দিন হবে। আমি আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ। আমি ওঠি তাহলে।’
আরিফ কিছু বলার আর সুযোগ পেল না। লোকটা আরিফ আর ছেলেটাকে বিদায় জানিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই লাপাত্তা হয়ে গেল।

‘তোমার নাম কী?’
‘স্যার, আমার নাম সাফায়েত মিয়া। তবে সবাই সাফাত বলেই ডাকে।’
‘আচ্ছা, সাফাত। তোমার জন্য আপাতত ছাদের পাশে একটা চিলেকোঠা আছে, ওটাই তোমার থাকার জায়গা। আমার মনে হয় ওটা তোমার পছন্দ হবে।’
সাফাত বাধ্য ছেলের মতো চিলেকোঠায় চলে যায়।


রৌদ্রা ব্যালকনিতে বসে বসে পাখির ডাক শুনছে। তার কাছে একেক পাখির একেক ডাক বেশ অদ্ভুত লাগে! খুব ইচ্ছে হয় তার পাখির মতো আকাশে ওড়তে। লি জিকি উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত লি জিকির চুলে হাত দিয়ে আরিফ ডাক দেয়।

‘এখনো ঘুমাচ্ছো যে! ওঠো। কথা আছে।’
‘হ্যাঁ। বলো না।’
‘বাড়িতে আজ থেকে একটা ছেলে থাকবে। ছোট মামা পাঠিয়েছে। আপাতত ওকে চিলেকোঠায় পাঠিয়েছি।’
‘তোমার ইচ্ছা।’
‘ডাক্তারের কাছে যাব। ফ্রেশ হয়ে নাও।’

আজ রৌদ্রার ইদ ইদ লাগছে। কত দিন পর বাবা মায়ের সাথে বের হয়েছে। ও জানে না, কোথায় যাচ্ছে! তবে ওর বাইরে বের হলেই বেশ আনন্দ লাগে! কত কিছু আছে দেখার মতো! এই যে এইখানে বসে আছে ওরা প্রায় বিশ মিনিট ধরে। এখানে কত্ত মানুষ! একেকজন একেক রকম ভঙ্গিতে কথা বলে। একেকজন একেক রকম পোশাক পরে। একেকজন একেক রকম হাঁটে। কী অদ্ভুত সব!

একজন নার্সের পোশাক পরা যুবতী আরিফকে ভেতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করল। আরিফের পেছন পেছন লি জিকিও চলতে শুরু করল। লি জিকি জানে না, এখানে কেন এনেছে ওকে। যতদূর ধারণা, মনে হয়, রৌদ্রার জন্যই এসেছে। কিন্তু চেম্বারের বাইরে বড় করে লেখা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। এসব ভাবতে ভাবতে দরজার ওপারে এক লোকের দিকে চোখ যায়। সব লি জিকির এক মনের কথা, কিন্তু যা দেখা যায়, তা কি সব সময় সত্য হয়?

‘আসুন আসুন।’
বেশ হাসি মুখেই বলল হানিফ। হানিফ একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ সাইক্রিয়াটিস্ট। সে আরিফের পরিচিত লোক। তবে আরিফের চাইনিজ স্ত্রীকে দেখার সৌভাগ্য আজই হলো তার। আরিফ নিজে একটা চেয়ার টেনে বসল। রৌদ্রাকে কোলে নিয়ে লি জিকি বসতে যাবে তখন হানিফ বেঁকে বসল।

‘আহা, বাচ্চা নিয়ে একদম না। এক কাজ করুন আপনার ওয়াইফকে পরে ডাকছি। উনি বাইরে বসুক।’
লি জিকি আরিফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই রুম থেকে বের হয়ে গেল।

‘এবার বলুন আরিফ সাহেব। নতুন আর কোনো উপসর্গ?’
‘আপনাকে সব মেইল করেছি গতকাল। আপনি দেখেননি?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি তো। ওগুলোই সমস্যা? তাহলে আপনার স্ত্রীকে ভেতরে পাঠান। আমি উনার সাথে কথা বলি।’

আরিফ বাইরে গিয়ে রৌদ্রাকে কোলে নিয়ে লি জিকিকে ভেতর যেতে বলল। লি জিকিও মুচকি হাসি দিয়ে বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেল।

‘তারপর বলুন। কেমন আছেন?’
‘জি ভালো। আপনি আমাকে কীজন্য ডেকেছেন আমি জানি! আমাকে একটু পানি দেবেন, মিস্টার হানিফ?’
‘অবশ্যই।’

হানিফ পানি এগিয়ে দেয়। লি জিকি যতটুকু সম্ভব নিচের দিকে ঝুঁকে তার শরীরটাকে মেলে ধরে, নিজের সৌন্দর্যকে বোঝানোর চেষ্টা করে হানিফকে। হানিফ এই অপরিচিতা মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের অস্তিত্ব ভুলে যায়। তার জুলুজুলু চোখদুটো লি জিকির সমস্ত শরীরে খেলা করতে থাকে। হানিফের কাছাকাছি চলে আসে লি জিকি।

‘এই সৌন্দর্য চাই আপনার?’ কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে হেসে বলে, লি জিকি!
হানিফের হাত ততক্ষণে লি জিকির শরীরে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিয়েছে। নেশাগ্রস্ত যুবকের মতো বলে, ‘এখুনি চাই। তুমি অনেক বেশি সুন্দরী!’
‘হ্যাঁ, এটা আপনাকে ভোগ করতে দেওয়া হবে। তবে গিভ এন্ড টেইক প্রসেসে। রাজি?’
হানিফ কিছু না ভেবেই সম্মতি জানায়। আজ ত্রিশ বছরের জীবনে এত কাছ থেকে কোনো নারীর শরীরের ঘ্রাণ, এত কাছে পেয়ে কেউ হাতছাড়া করে?

এর আধঘণ্টা পর লি জিকি শাড়িটা ঠিক করে হানিফের রুম থেকে বের হয়। আরিফ ওকে দেখে এগিয়ে আসে। আরিফকে দেখেই লি জিকি বলতে শুরু করে, ‘তুমি আমাকে মানসিক রোগী ভাবো? আগে বললেই পারতে। কত প্রশ্ন করল ডাক্তারটা। হুহ!’
‘তুমি বিরক্ত হয়েছো লক্ষ্মীটি? আমাদের ভালোর জন্যই তো।’
‘হয়েছে যাও। উনি তোমাকে ডাকছেন।’

আরিফ ভেতরে ঢুকতেই হানিফ বেশ তৃপ্তিময় হাসিতে ফেটে পড়ল।
‘আহা! এটা নরমাল বিষয়! তবে ওষুধ দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। আপনি সময় কম দেন এর ফল। একটু বেশি বেশি সময় দেবেন।’
‘আর পোশাক খুলে ফেলার বিষয়টা?’
‘ওটা নিয়ে আমি বিস্তারিত পরে বলব। তবে নিম্ফোমেনিয়া নামে রোগটা হওয়ার লক্ষণ আছে। অথবা, মাল্টিপল পার্সোনালিটি। আমি পরে বিস্তারিত জানাব আপনাকে। আপাতত আপনি উনাকে নিয়ে বিশ্রাম করুন। আর আপনি নিজে এই ওষুধটা খাবেন।’
‘কিন্তু আমি কেন ওষুধ খাব?’
‘আহা মিস্টার, নিজের অর্ধাঙ্গিনীর চাহিদা তো আপনাকেই মেটাতে হবে।’
আরিফ মানতে না চাইলেও ডাক্তারকে অবহেলা করতে পারছে না। তাই বাধ্য হয়েই উনার কথাগুলো মেনে নিলো।

রৌদ্রার মাম্মামের কোলে বসতে কেমন যেন অসহ্য লাগছে। কেমন যেন একটা অচেনা ঘ্রাণ! ঠিক ডাক্তার হানিফের রুমের ঘ্রাণটা যেন তার মাম্মামের শরীরে মিশিয়ে দিয়েছে কেউ। মাঝে মাঝেই ওর মাম্মামের শরীরের ঘ্রাণ অপরিচিত লাগে। একদম বিশ্রী একটা ঘ্রাণ আসে!

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

আলেয়া [ দ্বিতীয় পর্ব ] | ইসরাত জাহান জান্নাত

আলেয়া [ দ্বিতীয় পর্ব ] : ইসরাত জাহান জান্নাত

আলেয়া [ দ্বিতীয় পর্ব ] – ইসরাত জাহান জান্নাত

ছোটোগল্প | আলেয়া [দ্বিতীয় পর্ব]

ইসরাত জাহান জান্নাতের ছোটোগল্প | আলেয়া [দ্বিতীয় পর্ব]

ছোটোগল্প, সমকালীন গল্প, থ্রিলার, ফিকশন, গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: