প্রবল বাতাসে রুমের পর্দাগুলো এদিক-ওদিকে ওড়ছে। সমস্ত রুম মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানির আলোতে ভরন্ত। অথচ, লি জিকি তার পাঁচ বছরের মেয়ে রৌদ্রাকে বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মেয়ে রৌদ্রা ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। কান্নার আওয়াজে লি জিকির ঘুম যেন আরও তীব্র হচ্ছে। রৌদ্রা আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে তার গলার স্বর আটকে গেল, তবুও লি জিকির ঘুম ভাঙছে না।
ওইদিকে, এই পড়ন্ত বিকালে কাঁকভেজা হয়ে কালবৈশাখী ঝড়কে গালি দিতে দিতে আরিফ দরজার লক চাবি দিয়ে খুলছিল। আরিফ বেশ চিন্তিত। স্ত্রী লি জিকির এই ঘুমের স্বভাব তার জানা এবং তার মেয়ে রৌদ্রার ভয়াবহ কিছু হয়েছে ভেবেই বাজার থেকে ছুটে এসেছে সে। দরজা খুলেই আরিফ সোজা বেডরুমে গেল।
‘ও মাই গড! রৌদ্রা, আর ইউ ওকে? ওহ মাই ডিয়ার, কথা বলো! মামুনি, কথা বলো!’
রৌদ্রা নিস্তেজ হয়ে এক দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ যেমনটা আশঙ্কা করেছিল তেমনটাই হয়েছে। নিজের রাগ সামলাতে না পেরে লি জিকির তলপেটে একটা লাথি দিলো সে। রৌদ্রা ততক্ষণে আরিফের বুকে লেপ্টে আছে। লি জিকি ব্যথাটা বেশ জোরেই পেয়েছে, ধড়ফড় করে উঠে বসল সে।
‘কী হয়েছে? মারলে কেন?’
জবুথবু হয়ে বসে বেশ উৎকণ্ঠা নিয়েই প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারল লি জিকি। লি জিকির মায়াবতী চোখ দুটো দেখে আরিফের বেশ মায়া হলো। ও রৌদ্রাকে কোলে নিয়েই লি জিকির মাথায় হাত দিলো।
‘ও লক্ষ্মীটি, কিছু হয়নি। রৌদ্রা ভয় পেয়েছে। রেডি হও ডাক্তারের কাছে যাব।’
লি জিকি আর কিছু না ভেবেই ওয়াশরুমে চলে গেল।
বাইরে এখনো প্রচুর বৃষ্টি। থামার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আরিফ বেশ চিন্তিত। রৌদ্রা যদিও বেশ খানিকক্ষণ আগেই মুখে খই ফুটিয়েছে। বিভিন্ন প্রশ্নে বাবাকে অধৈর্য করে তুলছে। বেশ চঞ্চল ও। মাত্র পাঁচ বছর বয়স ওর। অথচ, বুদ্ধির দিক বিবেচনা করলে মনে হবে আঠারো বছরের তরুণী। সব কিছু জানার প্রচণ্ড নেশা ওর। বেশ গুছগাছ, সাবলীল আর অত্যন্ত সুন্দরী। সুন্দরী বলতে শুধু সুন্দরী নয়, তার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দই যেন সৌন্দর্যের বাহক।
‘বাবাই, মাম্মাম এত ঘুমোয় কেন? মাম্মামের বাবাই কে? জানো বাবাই, মাম্মাম কার সাথে যেন কথা বলে! কে সে?’
শেষের কথাটা আরিফের মাথায় ঢুকে। লি জিকি কার সাথে কথা বলবে! এই বাসায় ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। সে একজন বায়োটেকনোলজিস্ট। তার রিসার্চের সুবিধার্থেই এই নিস্তব্দ রাজকীয় বাড়িটি কিনেছিল। সে সব সময় বাড়ির পাশের নিজের ছোট্ট গবেষণা ঘরেই কাটায়। মাঝে মাঝে এসে বউ-বাচ্চাকে সময় দেয়।
লি জিকি ভেজা চুল মুছতে মুছতে বের হয়। আরিফ মুগ্ধ হয়ে দেখে। মেয়ে রৌদ্রা ততক্ষণে ব্যালকনিতে চলে গেছে। তার পর্যবেক্ষণে এখন বৃষ্টির পানি।
‘কী, এভাবে তাকিয়ে আছো যে?’
আরিফ আস্তে আস্তে লি জিকির কাছে যায়। লি জিকির পিঠে হাত দিতেই লি জিকি কেঁপে ওঠে। অন্য হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো সরাতে থাকে আরিফ। লি জিকি আরিফের চোখে তাকিয়ে যেন ডুবে যায়। আরিফ পাগলের মতো কিছুক্ষণ চুমো খায় লি জিকিকে।
হঠাৎ রৌদ্রার কান্নার শব্দে দুজন হকচকিয়ে ওঠে। আরিফ লি জিকিকে ছেড়ে ব্যালকনিতে দৌড় দেয়।
‘বাবাই! বাবাই! বৃষ্টি কেন থামল! বৃষ্টি পড়তে বলো।’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বলল রৌদ্রা। আরিফ মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকে দেখে লি জিকি রুমে নেই। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও লি জিকিকে পাওয়া গেল না। কিছুটা হতাশ হয়ে ড্রয়িং রুমে বসতেই দেখে, লি জিকি হাসতে হাসতে মেইন দরজা দিয়ে ঢুকছে। লি জিকির শরীরে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে যায় আরিফ! তার শরীরে কোনো কাপড় নেই। শুধু একটা ওড়না, তাও দুই স্তনের মাঝে।
‘কই গিয়েছিলে? এরকম উলঙ্গ হয়ে?’
‘কই? কোথাও যাইনি তো!’
কথাটা বলেই এক দৌড়ে লি জিকি বেড রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আরিফ হতভম্ব হয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ বাড়িটা নিস্তব্দতায় ছেয়ে গেল। এদিকে রৌদ্রা আরিফের কোলেই ঘুমিয়ে গেল। আরিফের চোখেও খানিকটা ঘুম ঘুম ভাব। হঠাৎ লি জিকির দরজা খোলার শব্দে ঘুমের ভাবটা সরিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করল আরিফ। রৌদ্রাকে আস্তে করে সোফায় শুয়ে দিলো সে। এরপর, বেডরুমে ঢুকল। লি জিকি বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল। যেন কিছুই হয়নি!
‘তোমরা বাইরে বসে আছো, আমাকে ডাক দাওনি কেন? যে ঘুমটাই না পেয়েছিল আমার! রৌদ্রা খেয়েছে কিছু?’
আরিফ লি জিকিকে যতই দেখে ততই অবাক হয়। কেন! কীজন্যে এমন হচ্ছে! ও ভেবেও পায় না। আজ এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে আরিফকে।
‘এখানে বসো। তোমার সাথে কথা আছে।’
‘এই যে বসলাম, বলো।’
আরিফের কোলে বসেই বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলল, লি জিকি।
‘তুমি কি নতুন কাউকে ভালোবাসো? আমাকে সরাসরি বলতে পারো, আমি তোমাকে আটকাব না!’
লি জিকি যেন আকাশ থেকে পড়ল। আরিফের কলার ধরে বেশ রোমান্টিকভাবেই বলল, ‘তোমার কি মতিভ্রম হয়েছে কলিজা? ভালো তো তোমাকেই বাসি। তাই আমার সর্বস্ব ছেড়ে, চীন ছেড়ে সেই দশ বছর আগে চলে এসেছি। এসব কেমন প্রশ্ন কলিজা?’
আরিফ লি জিকির চুল সরাতে লাগল। আরিফ জানে না লি জিকির এই চোখে কী জাদু! সেই প্রথম দিন থেকেই ওই চোখের দিকে তাকালে সে খুন হয়ে যায়। ওর আর ইচ্ছে হয় না কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলতে। বাইরে আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রৌদ্রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সময়টা যেন ওদের খুব কাছে আসার। দুজন আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেল না। একে অপরকে পাগলের মতো কাছে টেনে নেওয়ায় মেতে ওঠল। আস্তে আস্তে রাত নামতে লাগল। রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দুটো শরীরের চাহিদা। ওরা রৌদ্রার কথা কিছুটা ভুলেই গিয়েছিল। লি জিকি হঠাৎ বুক থেকে আরিফকে সরিয়ে দিলো।
‘রৌদ্রা অনেকক্ষণ ধরে ড্রয়িং রুমে। কিছু খায়নি মেয়েটা। এখন রাখো। আর না!’
আরিফ যেন উম্মাদ হয়ে গেছে। নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারছে না। নতুন বিবাহিত দম্পতি মতো যেন আরিফের সমস্ত যৌবন উপচে পড়ছে!
‘আরেকটু লক্ষ্মীটি। আমি মরে যাব, তুমি এখন চলে গেলে।’
লি জিকিও সায় দিলো আরিফের সাথে। কিছুক্ষণ পর লি জিকি শাড়ি পরে চলে গেল মেয়ের কাছে। আরিফ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে। ওর মতো সুখী কেউ নেই। শুয়ে শুয়ে শুনে লি জিকি আর রৌদ্রার কথোপকথন। এ যেন এক সুখী পরিবারের গল্প।
‘মাম্মাম, আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাব আর ভেজিটেবল স্যুপ।’
‘ওকে মামুনি।’
‘মাম্মাম স্যুপ এত মজা কেন?’
‘জানি না তো সোনামণি!’
‘আচ্ছা, তুমি কার সাথে কথা বলো!’
রৌদ্রার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে বেশ চমকে যায় লি জিকি। তার মানে রৌদ্রা কি ওকে দেখেছে? আরিফকে বলেছে নাকি! নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খায় ওর মাথায়। ও কথা ঘুরায়।
‘জানো রৌদ্রা, তোমার নানা খুব চমৎকার মানুষ। উনি ভালো গল্প জানেন। এখন তুমি স্যুপ খাও। আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই করি। ওকে মণি?’
রৌদ্রা বাধ্য মেয়ের মতো স্যুপ খায়। কিন্তু ওর মনে এই প্রশ্নটা গেঁথে থাকে— ‘মাম্মাম কার সাথে কথা বলে? কে সে?’
(চলবে)
[কীওয়ার্ডস:
আলেয়া [ প্রথম পর্ব ] | ইসরাত জাহান জান্নাত
আলেয়া [ প্রথম পর্ব ] : ইসরাত জাহান জান্নাত
আলেয়া [ প্রথম পর্ব ] – ইসরাত জাহান জান্নাত
ছোটোগল্প | আলেয়া [প্রথম পর্ব]
ইসরাত জাহান জান্নাতের ছোটোগল্প | আলেয়া [প্রথম পর্ব]
ছোটোগল্প, সমকালীন গল্প , থ্রিলার, ফিকশন, গল্পীয়ান]
Pingback: আলেয়া [দ্বিতীয় পর্ব] | ইসরাত জাহান জান্নাতের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan