এক.
বাজারের গলি-ঘুপচির মধ্যে বিশাল বিশৃঙ্খল ওয়ার্কশপ। তার এক কোনায় একটা পুরোনো ইঞ্জিন জবুথবু পড়ে থাকে। লোহা-লক্কড়ের স্তুপের মতো মুমূর্ষু পড়ে পড়ে ঝিমোয়। অলস ও ক্লান্ত দুপুরের আড্ডার সময় এর ওপর কেউ কেউ বসে থাকে। খাবার সময় হয়ে গেলে টেবিল বা খাট আশেপাশে খুঁজে না পেয়ে কেউ বা এরই বুকে-পিঠে বসে পড়ে। বিচিত্র ধাতব গন্ধের মাঝে ওয়ার্কশপের লোকজন, বিশেষত ছেলেটি বিচিত্র নাট-বল্টু নিয়ে বিচিত্রতর কাজ করে চলে। ওর নাম রাজন বা রবিউল বা অন্য কিছু হবে একটা।
বাচ্চা বয়সের ছেলেটির এতসব ঝুঁকিপূর্ণ ঝক্কির কাজ করতে যাওয়া দেখে প্রথমদিকে অনেকের অবিশ্বাস হতো। দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় এতদিন পর আর বেখাপ্পা লাগে না। গা-সওয়া হয়ে গেছে এসব কর্মমুখর ব্যাপার-স্যাপার। দিনের পর দিন স্কুলে না গিয়ে গিয়ে, গালি খেয়ে খেয়ে, লোহা-লক্কড় ঝালাই করতে করতে ছেলেটির অস্থি, মজ্জা লোহা হয়ে গেছে বলেই অনেকের সঙ্গত একটি ধারণা এতদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওর হৃদয়টা একটা জড়ভরত ইঞ্জিনের পিণ্ডের মতো আকৃতি নিয়েছে- এরকম একটা বোধ যে এই এলাকার অনেকেই পোষণ করে থাকে; তা বুঝা যায় ওর প্রতি ওদের আচরণ থেকেই।
বহুদিন ধরে ওয়ার্কশপের এক পাশে জং ধরা ইঞ্জিনটাকে পড়ে থাকতে দেখে একে উল্লেখযোগ্য কিছু মনে হয়নি। ছেলেটি ইঞ্জিনের সাথে মাঝে মাঝেই যেসব কথাবার্তা বলত– শুনে অনেক সময় অনেকের হাসি এবং অনেকের বিরক্তিও উৎপাদন করত। ইঞ্জিনটার সাথে ওর কথা বলার বাতিক মাঝে মাঝেই এমন উদ্ভট ঠেকত যে, ছেলেটির মানসিক সুস্থতার ব্যাপারে সন্দেহ না থাকার কোনো কারণ বাকি থাকত না।
‘কি রে জাম্বু, মন খারাপ? দাঁড়া, মুইচ্ছা দিতাসি। তর আর চিন্তা কি! বুড়া অইয়া গেসস গা। অখন খালি ঘুম আর ঘুম।’
ইঞ্জিনটা তবু মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমায়। অথবা ঝিমোয়। ছেলেটার সাথে ইঞ্জিনের কাল্পনিক কথোপকথন থেকে এই মর্ম উদ্ধার করা যায় যে, কেজি দরে ওজন করে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া ইঞ্জিনটার আর গতি নেই। মালিককে দেওয়ার মতো কিছু আর নেই এ লোহার স্তুপের। বহু পুরোনো লোহা। ওর চামড়ায় জং ধরে ধরে বছর বছর এক পরত করে পড়ে যাচ্ছে। তালগাছের বেড়ে ওঠার মতো আস্তে আস্তে আরও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। সাপের খোলসের মতো প্রত্যেক বর্ষায় একবার করে আর এক পরত চামড়া ক্ষয়ে যায় ওর। নাড়াচাড়া করতে গেলে ঝুরঝুর করে খসে যেতে পারে কিছু কলকব্জা।
ছেলেটা যখন আরও বাচ্চা বয়স থাকতে এই ওয়ার্কশপে এসে ঢুকেছিল, তখনো জড়ভরত ইঞ্জিনটা এমনি মর মর অবস্থায় ছিল। আজও তা-ই আছে। তখনো প্রতি বর্ষায় টিনের চালা থেকে গড়িয়ে পড়া জলের ধারা ইঞ্জিনের শরীরে এসে পড়ত, এখনো পড়ে। এবং তাতে করেই প্রকৃতপক্ষে জং ধরে ক্রমশ।
‘আমার অবস্থা তর থাইক্কা ভালা না। তর ত দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া দিন শেষ। আয়ু শেষ। বুড়া বয়সে বেশি বেশি তেল খাস দেইখ্যা এইখানে ফালাইয়া রাখসে। দয়া নাই, মায়া নাই।’
ছেলেটার কারও কাছ থেকে জেনে থাকার কথা ব্যাপারটা। বৃদ্ধাশ্রমের বুড়োদের মতো অলাভজনক হয়ে পড়ার কিছুদিনের মাথায় এর আশ্রয় এসে জোটে এইখানে। শেষের দিকে এসে ক্রমশ আরও বেশি তেল ইঞ্জিনটা খেয়ে যাচ্ছিল বলে ওকে নিংড়ে নিয়ে অবশেষে বাতিল করে এখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল কেউ বা কারা।
দুই.
একটি বাচ্চা মেয়ে যে প্রায়ই পাহাড় আর সমুদ্রের স্বপ্ন দেখত, একদিন রাতে সে স্বপ্ন দেখল যে, তার হলুদ জামাটি চুরি হয়ে গেছে। ওয়ার্কশপের পাশেই ওদের বাড়ি। ভয়ানক শব্দ আর আগুনের ফুলকির জোনাকিতে বিরক্ত হতে হতে শেষে অবসাদ অনুভব করে মেয়েটির পরিবারের লোকজন এখন আর টুকরো-টাকরা ধাতব উপকরণের প্রতি আন্তরিক ভেংচি কাটতেও পারে না। বহু আগেই একটা সময়ে এসে তাদের ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ঘুম ভেঙে উঠে বাচ্চা মেয়েটি তার জামাটি যথাস্থানে খুঁজে পেলেও ভরসা রাখতে পারেনি। ওয়ার্কশপের যে অন্ধকার প্রায় কোনে ইঞ্জিনটা পড়ে থাকে; অনেক ভেবে ভেবে এরই কলকব্জার ভেতর সে জামাটি নিরাপদ মনে করে রেখে দেয়। ভাঙাচোরা এই লোহার স্তুপের প্রতি চোরের কোনো আগ্রহ থাকার কথা না- এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। আগামী রোববারে স্কুলে তার ভর্তি হতে যাওয়ার কথা। ওইদিন এসে সবার সামনে দিয়ে জামাটি ইঞ্জিনের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে যাবে। এর ভেতরে জামাটি ছিল জানতে পেরে সবাই অবাক হয়ে যাবে। তারপর এটি পরে প্রথম দিন স্কুলে যাবে।
হইচই শুনে ওয়ার্কশপের পাশের বাড়ির বাচ্চা মেয়েটি দঙ্গলের দিকে আসে চোখ কচলে। ওয়ার্কশপের দিক থেকেই হট্টগোলটা আসছে বুঝতে পেরে সে ঢিপঢিপ বুকে সামনে এগিয়ে গেল। হলুদ জামাটি চুরি হয়ে যাওয়া ছাড়া ওয়ার্কশপের কাছে এতো হট্টগোলের কী কারণ আর থাকতে পারে! কিন্তু, গতকালও তো সে ওয়ার্কশপের ছেলেটির চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখে এসেছিল জামাটি ঠিক জায়গাতেই আছে। কালিঝুলি লেগে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে?
সে দ্রুত হইচইয়ের ভেতর হারিয়ে যায়। লোকজন উত্তেজিত কথাবার্তা বলছে।
একটা ইঞ্জিন। জং ধরা পুরোনো লোহার স্তুপ। এর নিচে চাপা পড়ে থেঁতলে আছে ওয়ার্কশপের ছেলেটা। বাচ্চা মেয়েটিকে কেউ ইঞ্জিনের কাছে যেতে দিচ্ছে না। কড়া ধমক খেয়ে সে পিছু হটল। একটু পর পুলিশ এসে কী কী সব লিখে আর কী কী সব করে চলে গেল। ভিড় আর চেঁচামেচির মধ্যে সারাদিন মেয়েটি ইঞ্জিনের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারল না।
পরদিন পর্যন্ত ওকে অপেক্ষা করতে হলো। ইঞ্জিনটা আগের জায়গাতে এনে রাখা হয়েছে আবারও। লোকেদের কাছে থেকে জানা যাচ্ছে যে, ইঞ্জিনের সাথে কথা বলতে বলতে ওইদিন ইঞ্জিনের ওপর ঘুমিয়ে গিয়েছিল ওয়ার্কশপের ছেলেটি। প্রচুর ঘুম পেয়েছিল নাকি। সংসারে ওর কেউ নেই। ইঞ্জিনটাকেই মায়ের বা বাপের কোল ভেবে নিয়ে আঁকড়ে ধরে শুয়েছিল ছেলেটি। কাজের চাপ গিয়েছে গত কয়েকদিনে প্রচুর।
ওয়ার্কশপের মালিকটি এত কাজকর্ম ফেলে রেখে ছেলেটিকে অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে ক্ষুণ্ণ হয়। আরও কারা সব ছিল, সকলে মিলে ইঞ্জিনটিকেই ছেলেটির শরীরে লেলিয়ে দেয়। তার আগে ছেলেটি চিৎকার করে থাকতে পারে। আশেপাশে কিছু না পেয়ে ইঞ্জিনের কলকব্জার ভেতর হঠাৎ একটি হলুদ জামা আবিষ্কার করে তা-ই ছেলেটির মুখে গুঁজে দিয়েছে তাদের কেউ একজন।
সুতরাং, হলুদ জামাটি আর নেই। ওয়ার্কশপের মালিককে ধরা হয়েছে। মামলা হয়েছে এবং মামলার আলামতে তা কাজে লাগবে। হলুদ জামাটি আসলে চুরি হয়েই গেছে।
******
আরও পড়ুন: বই রিভিউ | একা [উপন্যাস] – মৌলী আখন্দ
আরও পড়ুন: একজন মানুষের খোঁজে [প্রতিযোগিতার গল্প]
কীওয়ার্ডস: [ একটি ইঞ্জিন ও হলুদ জামা – রাহুল চন্দ্র দাস , একটি ইঞ্জিন ও হলুদ জামা , রাহুল চন্দ্র দাস , একটি ইঞ্জিন ও হলুদ জামা | রাহুল চন্দ্র দাস , গল্পীয়ান , জীবনধর্মী গল্প , নন-ফিকশন , প্রতিযোগিতার গল্প , ছোটোগল্প , বিয়োগাত্মক গল্প ]