গহীনে আঁচ_ফৌজিয়া খান তামান্না

ফৌজিয়া খান তামান্নার উপন্যাস ‘গহীনে আঁচ’ | রিভিউ: মৌলী আখন্দ

পরিপক্ক লেখনীতে পরিপক্ক জীবনবোধের পরিপূর্ণ প্রকাশ উপন্যাস – ‘গহীনে আঁচ’। লেখকের এটি প্রথম উপন্যাস। কিন্তু বইয়ে তার কোনো ছাপ ছিল না।

কাহিনি সংক্ষেপ:

উপন্যাসের প্লট কৌতূহলোদ্দীপক। রিমন নামের ছেলেটি শৈশবেই প্রেমে পড়ে তার চেয়ে বয়সে বড়ো মামাত বোন মুনার। এরপর রিমনের বাবার দ্বিতীয় বিয়ে, রিমনের মায়ের জীবন সংগ্রাম, মুনার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে আদিল নামের একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া, কষ্টে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েও রিমনের মুনাকে কিছুই বুঝতে না দেওয়ার মধ্য দিয়ে কাহিনি এগিয়ে গেছে। যথানিয়মে এরপর রিমন আর মুনার মধ্যে দূরত্ব, যার যার সংসারে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া। এটাই স্বাভাবিক।

বহু বছর পরে নিয়তি আবার কেন মুখোমুখি দাঁড় করাল তাদের দুজনকে? জীবন ও নিয়তির নিষ্ঠুর খেলা তাদের দুজনকে আসলে ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে?

উপন্যাসের অনন্যতা:

গড়পড়তা গতানুগতিক উপন্যাস থেকে ‘গহীনে আঁচ’ এর ভিন্নতা ঠিক কোথায়? লেখক উপন্যাসটি উত্তম পুরুষে অর্থাৎ রিমনের জবানিতে লিখেছেন যা তার মুন্সিয়ানার পরিচায়ক। প্রতিটি চরিত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ মনোবিশ্লেষণ লেখকের অনন্য বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শুধু লেখকের লেখনশৈলীই নয়, ‘গহীনে আঁচ’ এর অনন্যতা অন্য জায়গায়। এই উপন্যাস খুব সহজ ভাষায় কিছু বৈষম্যের কথা বলে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কিছু নির্মম সত্য। ছড়িয়ে দেয় কিছু অদ্ভুত জীবনবোধ। তুলে ধরে এমন কিছু অন্যায়ের বিবরণ যা আমাদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত; কিন্তু আমরা দেখেও দেখিনি, প্রতিবাদ করিনি।

আরও পড়ুন: একা | মৌলী আখন্দ | রিভিউ: সালসাবিলা নকি

উপন্যাসের এমনই কিছু অংশ:

‘এত এত লেখাপড়া করে আমার হলোটা কী? কত মনোযোগ, কত আশা নিয়ে একেকটা পরিবার ছেলেদের পাশাপাশি তাদের মেধাবী মেয়েদেরও পড়াশোনা করায়, ক্লাসে একটা দুইটা নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য অন্য ছেলেমেয়ের মায়েদের সাথে প্রতিযোগিতা করে।

কিন্তু সেই মেয়েদের ভবিষ্যৎ কী? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্য বাড়ির আহ্লাদী আধামানুষ বুড়ো ছেলেকে মানুষ করা।

স্বামী নামের সেই ছেলেগুলো একটা করে বলতে পারার মতো গুণসর্বস্ব গালভরা নামওয়ালা বউ চায়। কী গৌরব! ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া বউ আমার, সারাক্ষণ আমার কথায় ওঠে বসে। আমি বাজার করে এনে দিই, সে রান্নাঘরে বসে বটিতে ফেলে কেটেকুটে আমাকে রেঁধে খাওয়ায়। রাতের বেলা ম্যাজম্যাজ করা গা, হাত, পা টিপে দেয়। চাইলেই যে বউ নিজে উপার্জন করতে পারত, সে এখন দুইটা পাঁচটা টাকার জন্য আমার পকেট হাতায়, বা হাত পেতে চায়।

আহ! কী তৃপ্তি! তাহলেই বুঝে নাও, আমি কী মহাজন!

আমি সেই গালভরা ডাকের বউ হয়ে গেলাম রে।

আর প্রেম করে বিয়ে করা এসব মেয়েগুলো আরেক কাঠি বেশি ভোগে, বুঝলি? পরিবারের বিরুদ্ধে, সবার বিরুদ্ধে নিজের পছন্দটাকে সেরা বুঝাতে গিয়ে, সবকিছু হজম করে যায়। মেয়েগুলোর মনোভাবটা এমন থাকে যে, আমার স্বামীর একটাও দোষ যদি কেউ টের পায়, তাহলে তো আমার সিদ্ধান্তকে সবাই আঙুল তুলে দেখাবে। সেটা যে সবার কাছে আমার বিশাল হার। না, না। সে কিছুতেই সম্ভব না। আমি ভুগি। কিন্তু তা কাউকে টের পেতে দেওয়া যাবে না।

তার ওপর আছে, স্বামীর পরিবারের কাছে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার পাবন্দী। কেউ যেন বলতে না পারে, ‘কেমন বউ আনলি? বউ তো কথা শোনে না। আমরা পছন্দ করে আনলে এমন হতো না।’

*****

কিছু আগুন চোখে দেখা যায় না। কিছু আগুন ধিকিধিকি জ্বলে। ‘গহীনে আঁচ’ এমনই এক আগুনের নাম। এ সমাজের বৈষম্য আর অবিচারের মুখে এক সজোর চপেটাঘাত। আমাদের মুখোশপরা দ্বিমুখী আচরণের বিরুদ্ধে এক প্রবল প্রতিবাদ। এই সফল সাহসী দৃপ্ত উচ্চারণের জন্য লেখককে আমার টুপিখোলা অভিবাদন।

বইটি অবশ্যই সংগ্রহে রাখার মতো এবং উপহার দেওয়ার মতো একটি বই। আশা করি মেয়েরা নিজের প্রেমিক, স্বামী, বোন ও কন্যাকে এই বইটি উপহার দেবেন এবং পুরুষরা বইটি পড়ে ‘ভালোবাসা’ আর ‘নিজের করে চাওয়া’র মধ্যে পার্থক্য বুঝতে চেষ্টা করবেন।

এক নজরে: গহীনে আঁচ

বইয়ের নাম: গহীনে আঁচ

লেখক: ফৌজিয়া খান তামান্না

প্রকাশক: চলন্তিকা

প্রচ্ছদ: আল নোমান

মলাট মূল্য: ৩৬০ ৳

প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২১

লেখকের এই অগ্নিঝরা লেখনী যেন কখনো থেমে না যায়; বরং ‘গহীনে আঁচ’ থেকে শিখা অনির্বাণ হয়ে স্বমহিমায় প্রজ্জ্বলিত হয় ভক্ত পাঠকের পক্ষ থেকে এই আন্তরিক শুভকামনা রইল। অব্যাহত হোক লেখকের জয়যাত্রা।

রিভিউ: মৌলী আখন্দ

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: