০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
বাড়িওয়ালি আন্টি মারা গেছেন কয়েকদিন আগে। আংকেল প্রতি সন্ধ্যায় মেইন গেটের খোলা জায়গাটায় আতর, গোলাপজল ছিটান; আগরবাতি জ্বালিয়ে দেন। সব মিশ্রিত হয়ে একটা কড়া গন্ধ তৈরি হয়।
গেট খুলতে গিয়ে ঝাঁঝালো গন্ধটা আমার নাকে আসে। আমি কেমন যেন একটা মৃত্যু মৃত্যু ঘ্রাণ পাই। মাথার ভেতরের মগজগুলো গুলিয়ে আসে আমার। বমি আসতে চায়। পারি না। সিগারেট আর আগরবাতি আমার ভীষণ অপ্রিয়। তবুও রাস্তায় নেমে আমি সিগারেট হাতে নিই। আকাশে গ্রহণগ্রস্ত রক্তিম চাঁদ। সুপার ব্লাড মুন। ১৫২ বছরের প্রাচীন চাঁদ মাথার ওপর ঝুলে থাকতে দেখে আমি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি।
বিষণ্ণতা আমাকে কুকুরের মতো টানতে টানতে স্মৃতির সমুদ্রে নিয়ে ফেলে দেয়। আমি না জ্বলানো সিগারেটটা নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দিই তীব্র আক্রোশে। এরপর শীতে কাঁপতে কাঁপতে এগোতে থাকি। দুদিন ধরে কিছু না গেলা আমার পাকস্থলীটা নিজেই নিজের প্রাচীরে হাতুড়ি পেটাতে থাকে। আমার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তখন একান্ত ভিন্নচিন্তায় মগ্ন।
আমার মৃত্যুতে আগরবাতি জ্বলবে না, কিছু শ্বাসকষ্টের রোগীকে সমস্যায় ফেলানো হবে না; ভেবে ভেবে আমার খুব আফসোস হতে থাকে। ভীষণ আফসোস।
**********
০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
দুদিন ধরে জ্বর। ভীষণ দুর্বল লাগে। রাত হলে বেড়ে যায়, ঘুমাতে পারি না! দিনে কমে আসে। সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা তো আছেই। সকালে সূর্যের আলো দেখলে ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর ঠা ঠা রোদের ক্লান্ত দুপুরে চোখ খুলি। অদ্ভুত জীবন আমার!
আজ সম্ভবত ১৯ দিন, ক্যাম্পাসে যাই না। সবার মাঝে একটা মিথ প্রচলিত আছে, ভার্সিটি মানে মুক্ত জীবন, একঝাঁক হাসিখুশি আর ভালো থাকা মন। অথচ আমি একটুও ভালো নেই। আমার জীবনটা সংকীর্ণ হতে হতে- বাসা, মধু মিয়ার পুল আর কলেজ; এতটুকুতে আবদ্ধ হয়ে গেছে।
আজকাল খাবার মুখে নিতে পারি না। সবকিছু তেঁতো তেঁতো লাগে। আজকে অল্প একটু খেয়ে বাকিটা এঁটো রেখে দিয়েছি। বাইরে হালকা ঠান্ডা। কিন্তু জ্বরের কারণে ঠান্ডাটা বেশিই লাগছে। লেপ মুড়ি দিয়ে জ্বর আর মাথা ব্যথাকে শয্যাসঙ্গী করে শুয়ে আছি একটা অপরিচ্ছন্ন বিছানায়। শুয়ে শুয়ে এক বেকুব নারীর কথা ভাবছি।
আম্মা! আম্মাকে দেখি না আজ ২৬ দিন। আজ এই বেকুব নারীটা পাশে থাকলে হয়তো এক বস্তা বকা দিয়ে কান ঝালাপালা করে দিত। কিন্তু সেই সাথে, বেশি করে পেয়াজ-মরিচ দিয়ে ঝাল করে শুঁটকি রাঁধত ছেলের জন্য, যাতে তেঁতো মুখে খেতে পারে। মাথায় পানি ঢেলে চুলে বিলি কেটে দিত, ব্লাম কিংবা ভিক্স দিয়ে মাথা টিপে দিত। আর অনুযোগের সুরে বলত, ‘আমি না থাকলে তোর সেবা কে করে দেখবি নে!’ আসলেই দেখতে পাচ্ছি, এই দূর দেশে কেউ নেই আমার। সত্যিই ভীষণ একা আমি।
দিনে দুবার করে ফোন দেয় আব্বা-আম্মা। আমি তাঁদের খুব গুছিয়ে, সুন্দর করে মিথ্যে বলি। বলি, ‘হ্যাঁ, আমি ভালো আছি খুব।’ ফোনের ওপাশে আশ্বস্ত হোন তাঁরা। অথচ আমার ভেতরের অব্যক্ত কথাগুলো কেউ শুনতে পায় না। আমি তো বলতে চেয়েছিলাম, ‘আমি একটুও ভালো নেই। খুব খারাপ আছি! খুব খারাপ!’
জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। তারা দেখছি আর নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিচ্ছি এই বলে, ‘পৃথিবীতে অনেকেই ভালো নেই। একেক জন একেক রকম ঝামেলার সমুদ্রে ডুবে আছে। কিছু কিছু মানুষের যে ভালো থাকা পাপ।’
একটা চামচিকা ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আমার ওকে হিংসে হচ্ছে ভীষণ। আমি হেরে যাচ্ছি, আর পারছি না। ইচ্ছে করছে, দূরে কোথাও পালিয়ে যাই কিংবা আম্মার আঁচলে গিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কতদিন হলো, আম্মার আঁচলে ঘুমাই না! কত বছর হলো, আম্মার ঘ্রাণ নিতে পারি না! আমাদের হুটহাট বড়ো হয়ে যাওয়াটা কত জন্মের পাপের শাস্তি? আমি কেন বয়সটাকে আম্মার আঁচলে আটকে দিতে পারলাম না? খুব আফসোস হচ্ছে আমার!
**********
০৬ মে, ২০১৮
ক্যাম্পাসে সম্ভবত আমার শেষ রাত কাটাচ্ছি।
একরাশ বিষণ্ণতা ভর করেছে আকাশে। আশে পাশের বাতাসগুলোতেও গুমোট ভাব। পাশে অসুস্থ বন্ধু। সে মাঝে মাঝে প্রলাপ বকছে। অসুস্থ মানুষদের মুখে কী অদ্ভুত মায়া, আমি প্রথমবার খেয়াল করেছি!
কাল সকালে কাজ সেরে নীল বাসে চড়তে হবে শেষবারের মতো! তারপর লঞ্চের ডেকে শুয়ে রাতভর নদীর বুকে নিঃসঙ্গ যাত্রা। নতুন ভোর হবে। সাগরকন্যার বুক ছেড়ে আমি ঢুকে যাব ব্যস্ততাময় জাদুর শহরে। ইট-সিমেন্ট, লোকাল বাসে ঠাসা কর্পোরেট জীবন। প্রাচীনত্বের গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বিংশ শতকের বাড়ি আমার গন্তব্য।
তারপর হয়তো এপাশের মানুষগুলোর সাথে আবার কখন দেখা হবে সে হিসেব মিলাতে পারব না! জীবনের গতিতে কে কোন দিকে হারিয়ে যাব হয়তো বুঝতেও পারব না। তবুও ক্ষণিকের সম্পর্কগুলো খুব পোড়াবে আমাকে। খুব!
আমি হয়তো আমাদের দ্বিতীয় পরিবারের সদস্য ঠিকমতো হতে পারিনি। তবুও যতটুকু পেয়েছি, এই পরিবারের কাছে; সেটাও একজন্মের পূণ্যের ফল হয়তো!
প্রিয় মেটস, তোরা অনেক অনেক অনেক ভালো রে! খুব ভালোবাসি তোদের। তোদের কথা খুব করে মনে পড়বে; মিস করব অনেক!
**********
২০ এপ্রিল, ২০১৯
আজ দেশের কোনো একটা পাব্লিক ইউনিভার্সিটির বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল। কাজের ফাঁকে নিউজফিড ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ একটা ভিডিও সামনে চলে আসে। ওই প্রোগ্রামের নাচের ভিডিও, আমার মেটসরা খুব সুন্দর সাজুগুজু করে নাচছে…।
আমার কাজের হাত থেমে যায়। উদাস দৃষ্টি নিয়ে একমনে কম্পিউটার স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি। বাইরের কালবৈশাখী ঝড়ের মতো দমকা হাওয়া, কীভাবে যেন ত্বক ভেদ করে ঢুকে যায় হৃৎপিণ্ডে! ছ্যাঁত করে ওঠে!
মনে পড়ে ওটা আমার ক্যাম্পাস ছিল। আমার দুবছরের অজস্র অপমান সহ্য করে আদায় করা ক্যাম্পাস, আমার কয়েকশ নির্ঘুম রাতের উপহার দেওয়া ক্যাম্পাস! যে ক্যাম্পাসে ক্লোরিফিল আছে, প্রাণ আছে, উচ্ছ্বাস আছে, বন্ধুত্ব আছে। মন খারাপ হলে যে ক্যাম্পাসে আকাশ ও জলের মিতালি দেখা যায়, যে ক্যাম্পাসে র্যাগ দিয়ে বড় ভাইরা রেস্টুরেন্টে খাওয়ায়, আর ওই ভাইদের কাঁধে মাথা রেখে বলা যায়- ভাই আমার খুব মন খারাপ, আমার কষ্ট হচ্ছে…!
আমি ওই ক্যাম্পাস, সবুজ ক্লোরোফিল, জলের শীৎকার আর একটা নীল বাস; সব পেছনে ফেলে চলে এসেছিলাম। অথচ পিছুটান ছাড়তে পারিনি আজও। হয়তো এই জন্মে পারবও না!
আজ হয়তো আমি মেটসদের সাথে থাকতাম। হয়তো নাচতাম না, তবু কোনো সাহিত্য সংগঠনের মেম্বার হয়ে অন্তত থাকতাম। হয়তো কাককণ্ঠী গলায় অনুষ্ঠানে স্বরচিত কবিতা আউলাতাম। হয়তো, বন্ধু-বান্ধবীদের গুতানিতে আমার পড়াশোনা এখনের মতো হতো না, ওরা আলাদিনের দৈত্যের মতো সব সমস্যার সমাধান করে দিত আমার। হয়তো, আমার এই একরাশ বিষণ্ণতামাখা লেখাটার কখনোই জন্ম হতো নাহ! কিন্তু নাহ, এই অদ্ভুত মানবজন্মে অনেক ‘হয়তো’র উত্তর থাকে না।
যেদিন রেজাল্ট দিয়েছিল, আমি খুব শকড ছিলাম, দুটো কারণে। আমার লাইফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুইজন মানুষ চান্স পায়নি। আমি নিজেকে মানাতে পারছিলাম না, ওদের ছাড়া ক্যাম্পাস। মনের ভেতর অনেক দ্বিধা নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম স্বপ্নের দিকে। কিন্তু দ্বিধার সাথে পেরে উঠিনি। হার মানতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আমি হয়তো ওদের কখনো বিশ্বাসই করাতে পারব না, ওদের মিস যাওয়াটা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছিল আমাকে। থাক, কিছু অনূভুতি ওপরের উনার কাছেই জমা থাক!
এরপর দিন বদলালো। আমার সেই মানুষদের একজন (যাকে আমি বেস্ট ফ্রেন্ড ভাবি) আরেকটি পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স পেলেন। ৩ বছরের একসাথে পথচলা, সাপোর্ট, হাসি-কান্না, সব স্মৃতি, সবকিছু পেছনে ফেলে আমি এখন তার ব্লকলিস্টে। আর প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষদের কথা দ্বারা জর্জরিত হচ্ছি আমি- “অ্যাঁহহ, প্রাইভেটে পড়ো? এইটা আবার কী সাবজেক্ট? এই ভার্সিটির নাম তো জীবনে শুনিনি!” সাথে থাকে পাব্লিক ভার্সিটিতে পড়া কিছু মেরুদণ্ডহীন আহম্মকের টিটকারি!
আমার কাছে আসলে সাফল্যের কোনো ধরাবাঁধা পরিমাপক নেই। আমি বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা আর অন্যকিছু যাই শিখি না কেন, সবকিছু জ্ঞান আহরণ ও তা নিজের ভেতর ধারণ করার জন্য। মরার আগে আমি যত বেশি বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করতে পারব তাতেই আমার সন্তুষ্টি!
আর প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমার কখনোই চুলোচুলি ছিল না। কথিত বেস্ট স্কুল, বেস্ট কলেজে পড়ে আমি কখনো নিজের ভেতর অহংকার লালন করার সাহস করিনি। আমি সবসময় চেয়েছি মানুষ আমাকে চিনবে আমার নামে ও কর্মে। আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে নয়। এই জন্য স্যোশাল মিডিয়ায় আমার সবকিছু গোপন করে রাখা অনেক আগে থেকেই! কারণ আমি চাই- যত্রতত্র প্রতিষ্ঠানের নাম না বেচে, নিজের কাজ দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠানকে সম্মানিত করতে।
আরেকটা বিষয়, অনেকে জানলে অবাক হবেন, আমি একাধারে ন্যাশনাল, পাব্লিক ও প্রাইভেট তিনটেরই ছাত্র ছিলাম। তাই, কোনো একটাকেও যদি হেয় করা হয় আমার গায়ে লাগে।
আর যারা ভার্সিটি ও সাবজেক্ট র্যাংক নিয়ে অহম প্রকাশ করে, তাদের প্রতি বলছি, তারা অনেকেই আমি যে যে পাব্লিক ভার্সিটিতে চান্স পেয়েছিলাম, যেটাতে ভর্তি হয়েছিলাম এবং যে সাবজেক্টে পড়তাম, তার যোগ্যতা অর্জন করেননি!
যদিও ভার্সিটির র্যাংক বানানো অনুচিত, তবুও ভার্সিটির ইতিহাস, বয়স, সুযোগ সুবিধা, বিষয় (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয় একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস) এসবের কারণে একটা র্যাংক আপনা আপনি তৈরি হয়ে যায়। যেমন: বুয়েট ও ঢাবিকে চোখ বন্ধ করে দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেতাব দেওয়া হয়।
এই জায়গা থেকে বললে, আমার সেই বন্ধুটির ভার্সিটি ও বিষয়ের সাথে আমারগুলোর অনেক পার্থক্য। সে যদি দুটোতেই একসাথে চান্স পেত, নিশ্চিতভাবে আমাদের ভার্সিটিতেই ভর্তি হতো!
যাক সে কথা, সবাই যে যার মতো বুলি আউড়াক, আমার কোনো অনুভূতি হয় না! আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট অবগত আছি, এটাই আমার কাছে বেশ!
এতসবের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ হয়, থেমে যাই, শামুকের মতো গুটিয়ে থাকি। এরপর আবার জাগতে হয়, খোলস ভেঙে জেগে ওঠি, আলোর আশায় ছুটে চলা শুরু করি। এই যাত্রা অন্তহীন! ভালো থেকো প্রিয় ক্যাম্পাস, তোমার সবুজ ক্লোরোফিল নিয়ে!
**********
[কীওয়ার্ডস:
দিনলিপি সিরিজ [ প্রথম পর্ব ] | আবুল হাসনাত বাঁধন
দিনলিপি সিরিজ [ প্রথম পর্ব ] : আবুল হাসনাত বাঁধন
দিনলিপি সিরিজ [ প্রথম পর্ব ] – আবুল হাসনাত বাঁধন
মুক্তগদ্য | দিনলিপি সিরিজ [ প্রথম পর্ব ]
আবুল হাসনাত বাঁধনের মুক্তগদ্য | দিনলিপি সিরিজ [ প্রথম পর্ব ]
মুক্তকথা , মুক্তগদ্য , নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]