চলতি অমর একুশে বইমেলা ২০২২-এ ভূমিপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে লেখক শিহানুল ইসলামের তৃতীয় মৌলিক গ্রন্থ ও প্রথম উপন্যাসিকা ‘দ্রোহের দিনগুলোতে’। মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার এই বইটির রিভিউ লিখেছেন ইসরাত জাহান জান্নাত।
রিভিউ:
প্রচ্ছদ:
কথায় আছে- আগে দর্শনধারী, তারপর গুণবিচারী। একটা বইয়ের প্রচ্ছদ আমার মতো খুঁতখুতে মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রোহের দিনগুলোতে বইয়ের একদম ছিমছাম, মার্জিত রংয়ের প্রচ্ছদই যেন পুরো গল্পটা চোখে দেখায়। প্রচ্ছদ নিয়ে অভিযোগের জায়গা রাখেনি লেখক ও প্রচ্ছদকার।
#ভিজিট করুন: দিব্যপাঠ – সাহিত্য পত্রিকা
পাঠ-প্রতিক্রিয়া:
আমি নিরেট মানুষ। সোজা-সাপটা চলতে বেশি পছন্দ করি। রিভিউ লিখতে গিয়ে এত শব্দ খরচা করা আমার পোষাবে না, তার ওপর জীবনের প্রথম রিভিউ লেখা। তাই সার-সংক্ষেপে যা বলা যায় আরকি!
বরাবরের মতোই লেখক শিহানুল ইসলাম তার লেখার চমক এই ‘দ্রোহের দিনগুলোতে’ উপন্যাসিকায় রেখেছেন। অসাধারণ শব্দচয়ন, অতুলনীয় প্লট, সাবলীল বর্ণনা। এ ছাড়াও বোনাস হিসেবে ধাক্কায় ধাক্কায় বইয়ের নামের যথার্থতা। যদিও এটা তার লেখা প্রথম উপন্যাসিকা এবং তৃতীয় মৌলিক বই! কিন্তু, এক বসায় পড়তে পড়তে কখন যে শেষ হয়ে গেল ঠাহর করতে পারিনি।
গল্পের প্রধান চরিত্র ‘অপরাহ্ণ সরকার বা অপু’ বার বার তার জায়গায় আমাকে টেনে নিয়ে গেছে। যেন বইয়ের প্রতিটা ঘটনা আমার সামনে জ্যান্তব হয়ে ওঠেছে। একজন অন্ধ মানুষের জীবনের চড়াই-উতরাই, একটা নষ্ট শহরের আহাজারি নিয়েই মূলত এই উপন্যাসিকা।
#আরও পড়ুন: একা | মৌলী আখন্দ | রিভিউ: সালসাবিলা নকি
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনকে মূলে রেখেই লেখক খুবই সাবলীলভাবে একজন অপুকে দিয়ে, এই সমাজের অন্ধকার খুব ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। পাঠককে বার বার গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবেন গল্পের নায়ক অপু।
গল্পটা একজন অপুর জীবনের, যেখানে— অন্ধত্ব, শৈশব কিংবা কৈশোরের ব্যথাতুর স্মৃতি, একজন ‘রুমি’ নামের ‘দেবী’ অথবা বন্ধুত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে ‘ভালোবাসার’ প্রতিযোগিতা, এসবই বেশ পোক্ত ভাবে জড়িয়ে ছিল।
গল্পের চরিত্র খুব বেশি নয়, তবে প্রসেনজিৎ নামের চরিত্রটায় কিছুটা থমকে দাঁড়াতে হয়। এই চরিত্রটা ছাড়া যেন গল্পটাই অপূর্ণ থাকত। এমন প্রসেনজিৎরা আমাদের আশেপাশে আছে বলেই হয়তো অপুরা বেঁচে থাকে। সেটাই লেখক বেশ নিঁখুতভাবে দ্রোহের দিনগুলোতে বইয়ে উপলব্ধি করিয়েছে।
এ ছাড়া ‘সেঁজুতির’ কথা আলাদা করে বলতেই হয়। ‘সেঁজুতি’ চরিত্রটা এই গল্পে এমন ভাবে জেঁকে আছে, চাইলেও তাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। মনে হচ্ছিল, সেঁজুতি থাকুক, আরও কিছুক্ষণ। সেঁজুতি বলুক, চলতে থাকুক অবিরাম। ঠিক তেমনি কবির চরিত্রটাও ভুলে যাবার মতো নয়। কবিরের ভালোবাসায় জেতার যে আকুতি, বোনের প্রতি যে স্নেহ; তা পাঠককে বেশ তৃপ্তি দেবে।
#আরও পড়ুন: গহীনে আঁচ | ফৌজিয়া খান তামান্না | রিভিউ: মৌলী আখন্দ
শুধু ‘অপু’ চরিত্রটা বেশ শক্তভাবে ফুটেছে এমন নয়, প্রত্যেকটা চরিত্র, প্রত্যেকটা জায়গা, এমনকি অপুর ঘরের রান্নাঘর, রুমির মুখের কবিতা সব যেন জ্বলজ্যান্ত হয়ে উঠেছিল কল্পনায়।
শেষে এসে অন্যরকম এক টুইস্ট যা সত্যিই সাধারণ পাঠকদের ভাবনার বাইরে। আমি বেশ কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। বার বার মনে হয়েছে, লেখক অন্যায় করেছেন! কিন্তু এটাই তো আসলে লেখকের স্বার্থকতা। বইয়ের রেশ না কাটার যে টনিক তিনি লেখায় রেখেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়!
পুরো লেখাটায় কখনো মনে হয়নি- অতিরিক্ত বর্ণনা, অপ্রাসঙ্গিক শব্দচয়ন দেওয়া হয়েছে। বরং, প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা উক্তি খুবই নিঁখুতভাবে গল্পটাকে জীবন্ত করে তুলেছে, যা এই উপন্যাসিকার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।
এ ছাড়াও বইয়ে বেশ কিছু উক্তি আছে যা পাঠককে ভাবাবে, রেশ রাখবে মস্তিষ্কে, যেমন—
- ‘প্রসেন, মানুষের জীবনের চেয়ে প্রেম কখনো বড়ো নয়, হইতে পারে না।…’
- ‘কোনো কোনো আগুন এত পোড়ানোর ক্ষমতা রাখে যে, নেশায় পরিণত করে নিজেকে।’
- ‘চলে যাওয়া মানেই অভিমান। অভিমান মানেই তো ভালোবেসেছিলেন।’
এ ছাড়া রুমির বলা শেষ কথাটা— ‘অপু, আমায় মাফ কোরো না কখনো। কখনোই না। আমার যেন সারাজীবন এই অপরাধবোধটা থাকে।’
#আরও পড়ুন: এলাচিফুল | শানজানা আলম | রিভিউ: মৌলী আখন্দ
পুরো উপন্যাসিকা জুড়ে প্রেম-বিরহ-নিঁখুত ভালোবাসা যেমন পাবেন; পাবেন— ভ্রাতৃত্ব ও আত্মিক সম্পর্কের সুন্দর বিশ্লেষণ, পাবেন— ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পটভূমি! এই দ্রোহের দিনগুলোতে উপন্যাসিকার রেশ বেশ কিছুদিন মাথায় নিয়ে ঘুরতে চাইলে এই বইটা আপনার জন্য অন্যতম মনের খোরাক হবে। আর, লেখক শিহানুল ইসলাম-কে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটা লেখা উপহার দেওয়ার জন্য। সেই সাথে তার জন্য রইল একরাশ শুভকামনা ও ভালোবাসা।
এক নজরে: দ্রোহের দিনগুলোতে
বইয়ের নাম: দ্রোহের দিনগুলোতে
লেখক: শিহানুল ইসলাম
ধরন: মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসিকা
প্রচ্ছদকার: পরাগ ওয়াহিদ
মলাট মূল্য: ২২০ ৳
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১২
প্রকাশকাল: বইমেলা ২০২২
প্রকাশনী: ভূমিপ্রকাশ
রিভিউ: ইসরাত জাহান জান্নাত