জমির সাহেব আজ সকাল থেকে তেতে আছেন। রাতে ঘুম হয়নি। যেই ঘুমাতে গেছেন, অমনি বাড়ির সবাই চেঁচিয়ে আজান দেয়া শুরু করেছে। বলা নেই কওয়া নেই, অমন নিনাদ করে আজানের পেছনে হেতু কী, তার মাথায় ধরেনি। তিনি ধরানোর চেষ্টাও করেননি অবশ্য। তিনি যেটা করেছেন সেটা হলো, বিছানা থেকে খুব ধীরে সুস্থে নেমেছেন। এরপর বারান্দায় গিয়ে হাসানের গালে কষে একটা থাপ্পড় মেরেছেন।
হাসান হচ্ছে জমির সাহেবের একমাত্র ছেলে। ও থাপ্পড় খেয়ে ঠান্ডা হলেও, ওর মা ঠান্ডা হননি। তিনি মহিলা মানুষ, আজান দিতে পারবেন কি পারবেন না, এই চিন্তার মাঝেও মাত্র আজান দিতে শুরু করেছেন, এর মধ্যে এই কাণ্ডে তিনি আজান থামিয়ে রাগে চিৎকার করে উঠলেন।
‘তুমি আমার ছেলেকে মারলা কেন? তোমার জন্য কি বাসায় একটু আল্লাহর নামও নেওয়া যাবে না? মানুষ বয়স হলে নরম হয়, আর তুমি হচ্ছো খবিশ। বুইড়া খবিশ!’
‘আমি বুইড়া খবিশ?’
‘অবশ্যই বুইড়া খবিশ। শুধু খবিশ না, তুমি খাটাশও। বুইড়া খাটাশ!’
জমির সাহেব এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ভাবলেন, থাক! এই শোরগোলের মাঝেই ঘুমাবেন। কিন্তু, তার জো কোথায়! আজানের পর শুরু হলো মিছিল। এলাকার কিছু উটকো পোলাপান টানা শ্লোগান দিচ্ছে, ‘নারে তাকবির! করোনা করোনা, নিপাত যাক, নিপাত যাক!’ জমির সাহেব বোঝার চেষ্টা করলেন, মিছিলটা ঠিক কোথায় হচ্ছে। রাস্তায় নাকি তার বাড়ির ছাদে!
ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে সামান্য কিছু নাস্তা করা জমির সাহেবের নিত্যকার রুটিন। নাস্তার মাঝে অবশ্যই থাকবে চা—গ্রিন টি। ডাক্তারের নির্দেশ। এক কাপ চায়ে এক চামচ চা পাতার সাথে এক চামচ মধু। চিনি নেয়া যাবে না।
কিন্তু, আজ তার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। রেহানা রাগ করে ছেলের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছে। ছোট মেয়ে মিলিকে চায়ের কথা বলায়, সে এমনভাবে তাকিয়েছে, যেন তিনি একটা রাজাকার! এই এক সমস্যা। একজনকে কোনো অপরাধের কারণে শাস্তি দিলে, বাকি সবাই আলটিমেটাম দিয়ে বসে থাকে। বোঝে না, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এতে মন খারাপের কিছু নেই।
অগত্যা তিনি বারান্দায় এসে বসে আছেন একা একা।
‘গুড ইভিনিং, দুলাভাই!’
রফিক দাঁড়িয়ে আছে। জমির সাহেবের শালক। জমির সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘সকাল আটটার সময় এসে বলছ গুড ইভিনিং। ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে?’
‘সরি দুলাভাই! ভুল হয়ে গেছে। আসলে হয়েছে কী, ঘরে থাকতে থাকতে মাথাটা আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে। ভাবতেছি, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসব!’
‘তাহলে যাও, বাইরেই যাও। এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সরো, যাও আমার সামনে থেকে।’
‘রাগেন কেন দুলাভাই? রাইগেন না। এখন সময়টা রাগার না। আপনি হাইপ্রেশারের রোগী। রেগেমেগে কোনো একটা কাণ্ড ঘটালে শেষে কী অবস্থা হবে, বুঝতে পারছেন? হাসপাতালগুলোয় এখন শুধু করোনা করোনা। সবাই শুধু করোনার রোগী চায়। হাই প্রেশারের রোগীর বেল নাই।’
জমির সাহেব কিছু বললেন না। এই পাগলের সাথে কথা বলার কিছু নেই। এরা বংশগত পাগল। বোন পাগল, ভাই পাগল, চৌদ্দগুষ্টি পাগল।
‘কিছু বললেন দুলাভাই?’
‘না, কিছু না! বললাম, যাও বাইরে থেকে ঘুরে আসো। পুলিশের মাইর খেয়ে ঠান্ডা হয়ে আসো।’
‘পুলিশ কিছু করতে পারবে না, দুলাভাই। আমরা এলাকার পোলাপান। কিছু করলে উল্টো মাথা ন্যাড়া করে আলকাতরা লাগিয়ে দেবো!’
জমির সাহেব বিড়বিড় করলেন, ‘শালা পাগলের গুষ্টি!’
রফিক বলল, ‘দুলাভাই, টেবিলে আপনার নাস্তা দেওয়া হইছে। চলেন নাস্তা করে আসি।’
‘তুমি নাস্তা করো। আমি এখন কিছু খাব না। এক কাজ করো, কুলসুমকে বলো আমায় যেন এক কাপ চা দেয়।’
‘কী চা দুলাভাই? রং চা?’
‘আমি রং চা খাই?’
‘খান না, তাতে কী হইছে? আজকে খাবেন। গাইবান্ধার খবর জানেন না? এক বাচ্চা পেট থেইকা বের হইয়াই সবাইরে বলছে, ‘আপনারা যদি করোনা থেকে বাঁচতে চান, বেশি করে আদা দিয়ে রং চা খান!’ আমার কী মনে হয়, জানেন দুলাভাই? আমাদের দেশটার উপরে আল্লাহর এক বিশেষ রহমত আছে। এসব হচ্ছে তার নিদর্শন। পেট থেইকা বের হইয়াই কথা বলা, চাট্টিখানি কথা মনে করছেন?’
‘চুপ করো স্টুপিড। যাও আমার সামনে থেকে। ভাগো!’
রফিক হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। এবার বারান্দায় এসে ঢুকল হাসান। জমির সাহেব চোখ গরম করে তাকালেন। যত নষ্টের মূল এই ছেলেটা। এমনি আল্লাহর নাম মুখে আনে না, করোনা আসায় রাত বারোটার সময় গলা ফাটিয়ে আজান দেয়। পাড়াসুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙিয়ে গলা ফাটানো আজান, এ আইডিয়া ওকে যে দিয়েছে, ওর গালেও একটা থাপ্পড় লাগাতে পারলে মনটা শান্ত হতো। বেকুবের দল!
‘কী করছ বাবা?’
জমির সাহেব বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ বসে আছি, কিছু করছি না। অযথা প্রশ্ন করছ কেন? কী জন্য এসেছ?’
‘তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি বাবা। ‘থানকুনি’ লতার মিসওয়াক। খুব দুর্লভ জিনিস। করোনা তাড়াতে এর জুড়ি নেই।’
‘এদিকে এসো।’
‘কেন বাবা?’
‘এসোই না!’
হাসান এগিয়ে এলো। জমির সাহেব আরেকটা থাপ্পড় লাগালেন কষে। হাসান গালে হাত দিয়ে বেকুবের মতো চেয়ে থাকল।
জমির সাহেব বারান্দার গ্রিল ধরে দূরে তাকালেন। ঠিক এই সময়ই তিনি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। দূরে রাস্তায় কয়েকটা ছেলে কান ধরে উঠবস করছে। এর মাঝে রফিকও আছে। একটা পুলিশ লাঠি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে চিৎকার করে বলছে, ‘এরপরে বাইরে এলে ল্যাংটা করে ছেড়ে দেবো, বদমাইশের দল!’
জমির সাহেব আবার বিড়বিড় করলেন, ‘মানুষ কি আসলেই আতঙ্কে আছে? নাকি আতঙ্কের ভান ধরেছে? এই ‘ভান’ বিষয়টাতে বোধহয় বাঙালির আলাদা দক্ষতা আছে।’
[কীওয়ার্ডস:
ভান | গোলাম রাব্বি রাকিব
ভান : গোলাম রাব্বি রাকিব
ভান – গোলাম রাব্বি রাকিব
ছোটোগল্প | ভান
গোলাম রাব্বি রাকিবের ছোটোগল্প | ভান
ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]
Pingback: আলেয়া [দ্বিতীয় পর্ব] | ইসরাত জাহান জান্নাতের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: আলেয়া [প্রথম পর্ব] | ইসরাত জাহান জান্নাতের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan