সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

সায়াহ্নের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

হাসপাতালের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সাদিব। আষাঢ় মাস। কদিন ধরে বৃষ্টির থামাথামি নেই। সাদিব আনমনে বাইরের প্রকৃতির দিকে থাকিয়ে আছে। হাসপাতালের সামনে একটা বিশাল চালতা গাছ। গাছের পাতাগুলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে টিপটিপ বৃষ্টির জল পড়ছে। বাতাসের ঝাপটায় সাদিবের চোখে মুখে বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে। ওর ভীষণ মন খারাপ। ভীষণ কান্না পাচ্ছে ওর। কিন্তু সে কাঁদছে না। ছোটো বেলা থেকে সাদিব কাঁদতে শিখেনি। সাদিবের দাদু, হাসনাত সাহেব সব দুঃখ-কষ্ট থেকে আগলে রেখেছেন সাদিবকে। আজ তিনি মৃত্যু পথযাত্রী।

হঠাৎ করে সাদিবকে ডাক দিলো সানজা।
– ‘সাদিব! এদিকে আয়। ডাক্তার আংকেল
ডাকছেন।’
– ‘যাচ্ছি!’

ডাক্তার সাদিবের হাতে একটা প্রেসক্রিপশন দিয়ে, ঔষধগুলো আনতে বললেন। সাদিব, চলে গেল ঔষধ আনতে। ডাক্তারও বের হয়ে গেল। কেবিনে, সানজা বসে রইল হাসনাত সাহেবের পাশে। সানজা, সাদিবের ক্লাসমেট। একই কলেজে পড়ে ওরা। সানজা, ছাড়া সাদিবের আর কোনো বন্ধু, বান্ধবী নেই। ছোটবেলা থেকেই সে ভীষণ একা। সানজাও অনেকটা গায়ে পড়ে, নিজে থেকে বন্ধুত্ব করেছে। সাদিবের এই বিপদের সময়ে সানজা ছাড়া কেউই এগিয়ে আসেনি।

⏩ আরও পড়ুন: আত্মজা | আবুল হাসনাত বাঁধন

কিছুক্ষণ পর সাদিব ঔষধ নিয়ে ফিরে এল। হাসনাত সাহেব মিটমিট করে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও তিনি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কথা বললেন। গলার স্বরটা তেমন বড়ো হয় না।

  • ‘দাদু ভাই, অনেক বড়ো হয়ে গেছিস। এখন নিজের দায়িত্ব নিতে পারবি। ওপারে গিয়ে আমি শান্তিতে থাকতে পারব।’
  • ‘চুপ করো, দাদু! তোমার কিছু হবে নাহ। তুমি আবার ভালো হয়ে যাবে। আমরা গ্রামে গিয়ে একসাথে কৃষ্ণখালীতে মাছ ধরব। কিছুদিন পর ক্রিকেট বিশ্বকাপ। একসাথে বসে খেলা দেখব।’
  • ‘তা মনে হয় আর হবে নারে দাদু ভাই। ডাক্তার বলেছে, আমি আর ১০/১২ দিনের মতো বাঁচব। খুব গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে ভাই। এগুলা সব খুলে, এই বন্দীশালা থেকে আমাকে গ্রামে নিয়ে চল। গ্রামের মুক্ত বাতাস পেলে আমি ভালো হয়ে যাব।’
  • ‘তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও। ১৬ দিন পর তোমার জন্মদিন। আমরা সবাই মিলে গ্রামে গিয়ে তোমার জন্মদিন পালন করব।’

সাদিব, সানজা, হাসনাত সাহেব সবাই জানেন এগুলো সব আবেগের কথা। যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তবুও মানুষ মনকে প্রশান্তি দেবার জন্যে মিথ্যে অভিনয় করে। হাসনাত সাহেব আর সাদিব দুজনেই খুব পারদর্শী সেই অভিনয়ে। সানজা কোনো কথা বলে না। চুপ করে থাকে। কিন্তু এরা দাদা-নাতির কথাগুলো শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। হাসনাত সাহেবও চুপ হয়ে যায়। সাদিব আবার বাইরে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। হাসনাত সাহেবের চোখের কোনে জল জমে ঝাপসা হয়ে ওঠে। তিনি চোখ বন্ধ করে অতীতের কথা ভাবতে থাকেন।

বছর দশেক আগে এমনি এক বষার্র দিনে, হাসনাত সাহেব আর সাদিবকে রেখে তাদের পুরো পরিবার পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল। ইদের কয়েক সপ্তাহ আগেই পরিবারের সবাই একত্রে গ্রামে চলে যেতেন। সে বার সাদিবের স্কুলে একটা অনুষ্ঠান ছিল বলে সাদিব আর হাসনাত সাহেব শহরের বাসায় থেকে গেলেন। বাকিরা চলে গেল গ্রামের উদ্দেশ্যে। হাসনাত সাহেব আর সাদিবের পরদিন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনারা সেদিনই গিয়েছিলেন। তবে ইদ উপলক্ষে নয়, পরিবারেরর সবাইকে দাফন করতে। গ্রামে যাওয়ার পথে সাদিবদের কার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। কেউই বাঁচেনি। হাসনাত সাহেবের স্ত্রী, সাদিবের মা, বাবা এবং এক বছরের ছোট্ট বোনটা, সবাই মারা গেল। সেই থেকে হাসনাত সাহেব আর সাদিব একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন। একে অন্যের বেঁচে থাকার ভিত্তি হয়ে।

⏩ আরও পড়ুন: এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন

ভাবতে ভাবতে হাসনাত সাহেবের চোখ জলে ভরে ওঠে। সানজা দেখে বলে-
– ‘দাদু, প্লিজ কেঁদো না।’
– ‘আমি চলে গেলে সাদিবরে দেখিস বোন।’
– ‘এভাবে বলিয়ো না দাদু।’
– ‘ওর আর কেউ নেই রে আমি ছাড়া। ভীষণ একা হয়ে যাবে। ওকে আগলে রাখিস তুই।’
দুজনেই চুপ হয়ে যায়। আর কেউ কথা বলে না। দূরে একটা পেঁচার ডাক শুনা যায়।

১০-১২ দিন পার হয়ে যায়। হাসনাত সাহেব এখনো মরেননি। হাসপাতালের বেডে বেঁচে আছেন হাজার বছর আগের লাশের মতো। উনার জন্ম দিনের ৩ দিন আগে, গভীর রাতে তিনি স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখলেন। সেই যে কলেজে পড়ার সময় রসায়ন প্রাইভেটে স্ত্রীকে প্রথম দেখেছিলেন। একদম সেইরকম। উনার স্ত্রী উনার চেয়ে এক ক্লাস জুনিয়র ছিলেন। সেই প্রথম দিনের ড্রেস টা পড়ে এসেছে সে স্বপ্নে। হাসনাত সাহেব বললেন, ‘সাদিয়া, তোমাকে আজ পরির মতো লাগছে। উনার স্ত্রী কোনো কথা বললেন না। ঝাপসা কুয়াশার মাঝে হারিয়ে গেলেন। হাসনাত সাহেব অনেক ডাকলেন, ‘সাদিয়া, সাদিয়া, যেয়ো না। আমিও যাব। আমাকেও সাথে নাও।’

হুট করে উনার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলেন- অন্ধকার কেবিন। জানালা দিয়ে জোছানার আলো ঢুকে রুমটা খানিকটা আলোকিত করেছে। বেডের দুপাশে দুইটা চেয়ারে সাদিব আর সানজা ঘুমিয়ে আছে। বাইরের চালতা গাছটার ডালগুলো বাতাসে হালকা দুলছে। আকাশে মেঘ নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে।

জন্মদিনের আগের রাতে হাসনাত সাহেব উনার মাকে স্বপ্নে দেখলেন। মা উনাকে ডেকে কোলে তুলে নিয়েছেন। ঘুম ভাঙার পর হাসনাত সাহেবের মনে পড়ল, একদিন উনার মা বলেছিলেন- ‘হাসনাত সাহেব সন্ধ্যায় আধাঁর নামার একটু আগে জন্মেছিলেন। তখন বর্ষাকাল। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। উনার বাবা ছেলের কথা শুনে খুশিতে হাট থেকে ভিজে ভিজে চলে এসেছিলেন।’

২২ সেপ্টেম্বর, জন্মদিনের দিন, সূর্য ডুবার পর যখন সন্ধ্যা নামতে চলেছে, এমন সময় হাসনাত সাহেব মারা গেলেন। সাদিব, সানজা, সবাইকে ফেলে মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তানের সাথে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। সাদিব দাদুর জন্যে উপহার কিনতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে তিনি আর নেই। অনেক বছর পর সে কাঁদল। হাউমাউ করে কাঁদল।

⏩ আরও পড়ুন: অগল্প আগল্প ইগল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

সন্ধ্যায় হাসনাত সাহেবের লাশ গ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো। লাশ গাড়িতে তোলার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি থামল তাকে কবর দেওয়ার পর। এশার পরপরেই তাকে দাফন করে ফেলা হয়েছিল। মায়ের পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। যেই সায়াহ্ন বেলায় তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন, পৃথিবী থেকে বিদায়ও নিলেন সেই সায়াহ্ন বেলায়।

এখন অনেক রাত। বৃষ্টি থামলেও আকাশে কালো মেঘ জমে আছে। প্রকৃতি থমথমে। সাদিব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাদিবের কাধে হাত দিয়ে পাশে বসে আছে সানজা। সেও কান্না ধরে রাখতে পারেনি। দুজনের কান্নার সুর দূর অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।

গল্প: সায়াহ্নের গল্প

লেখা: আবুল হাসনাত বাঁধন

রচনাকাল: ১৮/০৫/২০১৫
স্থান: কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম।

প্রিয় পাঠক, সায়াহ্নের গল্প – গল্পটি ভালো লাগলে পরিচতজনদের সাথে শেয়ার করুন। আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা ‘সায়াহ্নের গল্প’ এর মতন আরও নতুন নতুন গল্প পড়তে চাইলে গল্পীয়ানের সাথে যুক্ত থাকুন।

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: