আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা _ আবুল হাসনাত বাঁধন

আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা

আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা

বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। দিনভর ঠা ঠা রোদ্দুর। অগ্নিতপ্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে মাত্র। পড়ন্ত বিকেলে রোদের তাপ অনেকটা কমে এসেছে। কর্ণফুলীর চির বহমান জলে চিকচিক করছে তীর্যক সূর্যের আলো। যেন আকাশ থেকে হীরক-বৃষ্টি ঝরে পড়ছে নদীর বুকে। কর্ণফুলীর বুকের উপর ঝুলে আছে সদ্য বানানো ‘শাহ আমানত সেতু’। ব্রিজের রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে আছে রিয়াদ। দূর থেকে লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি করছে। কিন্তু সেগুলো রিয়াদের কানে পৌঁছাচ্ছে না। আস্তে আস্তে হাত দুটো দু পাশে প্রসারিত করে সে। আকাশে একটুও মেঘের দেখা নেই। তবুও আজ বাতাসগুলো কেমন যেন শীতল শীতল! রিয়াদের সমস্ত শরীর জুড়িয়ে যায় নির্মল বাতাসের ছোঁয়ায়। তার দীর্ঘকায় ঘনকালো চুলগুলো হালকা উড়ছে বাতাসের ঝাপটায়। নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে তার। সমস্ত ঝুট-ঝামেলা থেকে মুক্ত। খানিকটা বুক ভরে শ্বাস নেয় রিয়াদ। নিশ্বাস ছাড়ার সাথে ভেতরে চাপা সব কষ্ট উগলে বাতাসের সাথে উড়িয়ে দেয়।

‘রিদু! রিদু!’ চারপাশ থেকে শব্দটা তার দু কানে আঘাত করে। হকচকিয়ে উঠে রিয়াদ! চারদিকে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ নেই। তবুও শব্দটা বাজতে থাকে মস্তিষ্কের কোনো এক গহ্বরে। আস্তে করে এক পা এগোয় সে। নিজেকে ওজনশূন্য মনে হয়। অভিকর্ষ বল প্রচণ্ডভাবে টানছে। বুকের বামপাশে ধুকপুকানি বৃদ্ধি পায়। আর কয়েক সেকেন্ড সময় আছে রিয়াদের। এই সময়ের মধ্যে শুধু মা আর ছোট ভাই রাকিবের মুখটা কল্পনা করতে পারে সে। বাকিদের কারও চেহারা মাথায়ই আসে না তার। এমন কী যে ছবিটা বহু বছর ধরে সযত্নে এঁকে রেখেছে হৃদয়ের মাঝখানে সেটাও না। কতদিন দেখা হয় না তার সাথে!

কর্ণফুলীর বুকে ঝপাস করে একটা শব্দ হয়। যেন ভারী কিছু পড়েছে জলে। রিয়াদের মুখে শেষবার উচ্চারিত হয়, ‘আম্মু আমায় মাফ করে দিয়ো! আমি তোমাদের সম্মান রাখতে পারিনি।’

বহু খোঁজাখুঁজি করেও রিয়াদের দেহটা পাওয়া যায় না। কর্ণফুলীর ঘোলাটে জলের অতলে হারিয়ে যায় কিছু নবীন স্বপ্ন, একটা দীপ্তিময় ভবিষ্যত! যখন স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে, তখন আত্মাও মারা যায়। রিয়াদের আত্মাও বেঁচে ছিল না। মৃত আত্মাটা দেহের শেকল থেকে মুক্তি পেতে ব্যাকুল হয়ে ছিল। শেষমেষ নদীপথেই নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু করছে আত্মাটা। পরদিন সকালে ভাঁটার সময়, ব্রিজ থেকে অনেক দূরে একটা চরে ভেসে ওঠে রিয়াদের আত্মাহীন দেহটা।

পুরো পরিবারে শোকের মাতম। তার মায়ের আহাজারি ছড়িয়ে পড়েছে বৈশাখী ঝড়ো বাতাসে। বাবা একেবারে নিশ্চুপ পাথর হয়ে গেছেন পুত্রশোকে। এদিকে রিয়াদের অন্তঃসত্ত্বা বড় বোনকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে মা হবে সে। তার ‘চড়ুই’ যে পৃথিবীর উপর অভিমান করে হারিয়ে গেছে, এখনো খবর পায়নি। বৃষ্টিসিক্ত বিষণ্ণ বিকেলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা হয় রিয়াদের বড় বোনের। ছেলে সন্তান। ওর দুলাভাই বিমর্ষ মুখে বলে, ‘তানিয়া, তোমার চড়ুই ফিরে এসেছে।’ এই কথার মর্ম বুঝতে দুই দিন লাগে তানিয়ার।

রিয়াদের মৃত্যুর খবর যখন ওকে জানানো হয়, ততক্ষণে রিয়াদের নিথর দেহটা আঁধার ঘরে একা একা ঘুমিয়ে গেছে কয়েক রাত। বাড়ির কেউই শান্ত করতে পারে না তানিয়াকে। অনেকটা উন্মাদের মতো হয়ে যায় মেয়েটা। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বিলাপ করে করে কাঁদে সে। রিয়াদের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রাম বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার পুনঃনিরীক্ষিত ও সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, রিয়াদ তথাকথিত গোল্ডেন এ+ পেয়েছে! পূর্বে প্রকাশিত ফলাফল ছিল ওএমআর মেশিনের ভুল। যে ভুলের খেসারত দিয়েছে রিয়াদ!

আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা | © আবুল হাসনাত বাঁধন

(২০/০৫/২০১৬)

আরও পড়ুন: অগল্প আগল্প ইগল্প

আরও পড়ুন: নিভৃত ভালোবাসা

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

1 thought on “আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা”

মন্তব্য করুন: