অগল্প আগল্প ইগল্প
‘হাতটা ব্যথা করছে খুব। গতরাতে হয়তো অনুভূতিশূন্য ছিলাম। বিকেলে ওজু করার সময় পানি লাগায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক দিন পর ফুলহাতা শার্ট পড়েছি যাতে আম্মার চোখে না পড়ে। পরিবার কিংবা সমাজের প্রশ্নবোধক দৃষ্টিগুলো আসলে খুবই মারাত্মক। শরীরের ভেতরের মানুষটাকে কতটা ছিন্নভিন্ন করে দেয় তা ওপারের উনিও জানেন কিনা সন্দেহ!
সন্ধ্যার পর আজ আকাশে চাঁদ ওঠেনি। আজ কি কৃষ্ণপক্ষ? জেনে লাভ নেই। কীই বা আসে যায়! এখন তো আর কেউ জোছনা কুড়োয় না। মসজিদের পাশের ডাস্টবিনটায় এক ঝাঁক মাছি ভনভন করছে। ইঁদুর মরেছে একটা। ইঁদুরের দুরন্ত জীবনচক্র বেশ লাগে আমার। ছোটবেলায় ভাবতাম, আমি যদি মানুষ না হয়ে ইঁদুর হতাম কিংবা ফড়িং! আমার নানি ইঁদুরের কল দিয়ে ইঁদুর মারতেন। আমি মনে মনে বলতাম, আমি ইঁদুর হলেও এতটা বোকা হতাম না কখনো, যে ছোট্ট একটা বিস্কিটের লোভে মারা পড়তে যাব। কিংবা ফড়িং হলে কখনো মাঠে নেমে আসতাম না। আকাশেই থেকে যেতাম, যাতে দুষ্টু ছেলেরা আমাকে ধরে ফেলতে না পারে।
ছোটবেলায় কত চালাক ছিলাম আমি! কেউ কখনো আমাকে ঠকাতে পারেনি। আর এখন? দিন দিন বড্ড বোকা হয়ে যাচ্ছি! আজকাল ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেকে ঠকাচ্ছি নিজেই। আগের চেয়ে কত বদলে গেছি আমি! এই আমিই অন্যের মনে অনুপ্রেরণা জোগাতে জোগাতে হয়রান হয়ে যেতাম। অথচ আজ, নিজের বেলায় শূন্য। চারদিকে শুধুই অসীম শূন্যতা!
উঁচু উঁচু দালানের কারণে চাঁদের আলো আসতে না পারলেও, মাঝরাত্তিরে জানালার পর্দা গলে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো ঠিকই আসে আমার অন্ধকার রুমে। পুরোনো ইন্সোম্নিয়াক আমি। বিছানায় উঠে বসি। আম্মার তিরস্কার, বাকিদের কথার ছুরি, সব গিজগিজ করে আমার মাথায়। খেয়াল করি, একঝাঁক অদ্ভুত পোকা এসে আমার চারপাশ ঘিরে ধরেছে, সম্মিলিত শব্দকম্পন সৃষ্টি করছে। আমি চোখ বন্ধ করে কান পাতি। ‘লুজার! লুজার!’ ক্ষীণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের শব্দ আঘাত করে আমার কানের পর্দায়, মস্তিস্কের গহ্বরে। তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমি পরাজিত নই! আমি পরাজিত নই!’
তারপর একরাতে আমি হেরে যাই না। ভার্সিটিতে চান্স পাইনি বলে আমার জীবন শেষ তো হয়ে যায়নি। এইতো আমি বেঁচে আছি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। নতুন একটা ভোর হয়তো শুধু আমার জন্যেই হবে। স্নিগ্ধ সকাল, পাখির গান, আকাশের শুভ্র নীরদ, এক ফালি প্রাচীন রোদ; এসবই তো আমার হবে। মরে গিয়ে কী হবে? আমি তো চেয়েছিলাম কবিতার নায়ক হতে। চেয়েছি ভাঙা জোছনায় নীরব স্নান। আমি নীরেন্দ্রনাথের ‘অমলকান্তি’ হতে চেয়েছিলাম। রোদ্দুর হতে না পারলেও আমি ফেরিওয়ালা হতাম। আমায় মুগ্ধ করেছিল টুংটাং সুর, ফেরিওয়ালার তীব্র গলা। বেলুন বিক্রেতার ঝোলাটার প্রতি আমার ভীষণ লোভ ছিল। আমি স্বপ্নে দেখতাম, বেলুন বিক্রেতা হয়ে গ্যাস বেলুনে চড়ে উড়ে যাচ্ছি অনেক দূরে। আমি এক আকাশ মুক্ত পৃথিবী চেয়েছিলাম, অমলকান্তি হতে চেয়েছিলাম।
আমি ভার্সিটি পড়ুয়া মেকি নায়ক কিংবা শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষ হওয়ার মিথ্যে স্বপ্নে বিভোর হয়ে সুন্দর পৃথিবীকে ফাঁকি দিতে চেয়েছি, দিইনি। এটা ঠিক, ভার্সিটিতে পড়া মানে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ভালো চাকরি, সুন্দরী বউ। কিন্তু আসলেই কি ওরা সবাই সুখী হতে পারে? কখনোই না! সুখ আপেক্ষিক জিনিস, মনের ভেতরের জিনিস। পৃথিবীর বাহ্যিক জিনিস দিয়ে কখনো সুখী হওয়া যায় না। প্রকৃত সুখ আত্মসন্তুষ্টিতে নিহিত। আমি আত্মতৃপ্তি নিয়ে, আমিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে পারছি কিনা সেটাই আসল!
আমি আজকাল বাঁচার মতোই বেঁচে থাকি। নিজেকে নিয়ে খুব সুখী আমি। প্রতিদিন বেশ ভালো থাকি কারও ফিরে আসার দীর্ঘতম অপেক্ষায়…!’
ইফাদ ভাইয়ের পুরোনো ডাইরি পড়ছিলাম। এখন আমি যতটা ফ্রাস্টেশনে আছি, ভাইয়াও ততটা ছিলেন। মরে যেতে চেয়েও মরেননি অনেক বার। অথচ, সে এখন জাবিতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করছেন ২য় বর্ষে।
‘অগল্প আগল্প ইগল্প’ | © আবুল হাসনাত বাঁধন
(১৮/১১/২০১৬)
Pingback: বিবর্তন | তৌফিক ফেরদৌস চাতকের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: একটি ভুলের গল্প | জান্নাতুন ফাতেমা রাত্রির ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: বিষাণ্ণিতা | আবুল হাসনাত বাঁধনের ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: নিভৃত ভালোবাসা | সালসাবিলা নকির অণুগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan