দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
ষষ্ঠ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
সপ্তম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
স্থানীয় থানা থেকে ফোন এসেছে। বাদলকে একবার যেতে হবে। তার প্রথম স্ত্রী মোমেনা তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেছে। নিজের নামে মামলা হয়েছে এজন্য যতটা না খারাপ লাগছে, তারচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে সম্মানের কথা ভেবে। সে নিজে একজন পুলিশ। তাকেই এখন থানায় যেতে হবে অপরাধী হয়ে। নিজের গ্রামে, নিজের এলাকায় এভাবে অপদস্থ হতে হবে ভাবেনি কখনো।
যদিও তার দ্বিতীয় বিয়ের সময় খানিকটা কানাঘুষা চলেছিল। বাহাদুর মাস্টারের বাড়ির মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পরে গিয়েছিল সেবার। কিন্তু সেটা স্তিমিত হতে সময় নেয়নি। গরীব ঘরের মেয়ে একটা আশ্রয় পেয়েছে, পরে এটাই বেশ প্রশংসনীয় হয়েছিল। কিন্তু আজ থানায় মামলা উঠার কারণে বংশের নাক কাটা গেল। মোমেনার ওপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে বাদলের। কোন কুক্ষণে যে সে বিয়ে করেছিল মোমেনাকে!
বাদল থানার উদ্দ্যেশ্যে বের হওয়ার সময় দেখতে পেল কোহিনূর রিংকি, পিংকি ও রবির সাথে লুডু খেলায় ব্যস্ত। এমন অদ্ভুত দৃশ্য সে বোধহয় এর আগে কখনো দেখেনি! গম্ভীর স্বরে সে কোহিনূরকে ডাকে, ‘এদিকে শুইনা যাও তো…!’
কোহিনূর তৎক্ষণাৎ ছুটে এলে সে বলে, ‘এখন কি রংতামাশা করার সময় নাকি?’
বাচ্চাদের দিকে একবার তাকিয়ে কোহিনূর সকরুণ দৃষ্টিতে বাদলের দিকে তাকায়। ইশারা করে বাইরে যাওয়ার। তারপর দাওয়ায় এসে নিচু কণ্ঠে বলে, ‘অগো মন খারাপ। মা আর বইনের দেখা পায় না আইজ কত্তদিন! তাই আমি অগো মন ভালো করার জন্যে খেলতিছিলাম। আপনি রাগ কইরেন না।’
বাদলের মনটা নরম হয়ে আসে। সে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার এতো দরদ ক্যান? তোমার তো না, সতিনের পোলামাইয়া। অগো আদর দেখাইয়া লাভ কী?’
কোহিনূর উদাসী কণ্ঠে বলে, ‘আমি তো লাভ-ক্ষতির কথা চিন্তা কইরা কিছু করতিসি না। বাপ মরণের পরে চাচা, ফুফুরা কুত্তার মতো ছেই ছেই কইরা তাড়াইছে। মার লগে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরসি। কারও থেইকা একটু ভালো ব্যবহার পাইলে মনডা ভইরা যাইতো। আর যারা খারাপ ব্যবহার করতো তাদের কথাও মনে আছে অখনও। এগুলা আমার পোলা মাইয়া না হইলে কী হইসে, আমার মতো মানুষ তো। মন ওদেরও আছে। খারাপ ব্যবহার করলে খারাপ লাগব আর ভালো ব্যবহার করলে ভালো লাগব। সবচেয়ে বড় কথা এইসব ঘটনা আজীবন মনের মইধ্যে গাইত্থা থাকব। আমি চাই না, আমার কথা কারও খারাপভাবে মনে পড়ুক। আমার কথা যখন মনে পড়ব, তখন বলব- নাহ, মহিলা ততো খারাপ আছিল না। ভালই ছিল!’
কোহিনূরের সরল মনে বলা কথাগুলো বাদলের মনে গভীরভাবে দাগ কাটল। একটু আগেই মনে হচ্ছিল মোমেনাকে বিয়ে করে কী ভুলটাই না সে করেছে। আর এখন মনে হচ্ছে নিশ্চয় কোন ভালো কাজের ফল স্বরূপ সে কোহিনূরকে পেয়েছে। কিন্তু তার মূল্য দিতে পেরেছে কি? কোহিনূরকে সে বরাবর বঞ্চিত করেই এসেছে। স্বামীর সোহাগ থেকে, নারীত্বের মর্যাদা প্রাপ্তি থেকে, মাতৃত্বের স্বাদ থেকে; তবু এই মেয়েটার মুখে অভিযোগের লেশ মাত্র নেই!
বাদল তীব্রভাবে অনুভব করে, সবকিছু যদি ঠিক করে ফেলা যেত! তার জীবন যদি এত অগোছালো না হয়ে সাজানো হতো। এখন কি আদৌ সেটা সম্ভব!
থানায় পৌঁছে দেখতে পায় আগে থেকেই মোমেনা তার ভাইকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে আছে। সাথে আরেকজন লোক, যাকে দেখে ঠিক সুবিধার মনে হলো না। নিজের নাম বলল, তাহের নূরী। অমুকের ডান হাত, তমুকের বাম হাত, অমুক নেতা তার পা ধরে সালাম না করে কোনো মিটিং করেন না, হেন তেন সহ…!
এই থানার এসআই জলিলের সাথে বাদলের ভালো সম্পর্ক আছে আগে থেকেই। বয়স্ক কিন্তু পেটানো শরীর, সাথে তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ। বাদলকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল। হাসিমুখে করমর্দন করে বসতে দিলো। সেটা দেখে বাদীপক্ষের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। তবু তাহের নূরী মফিজের হাতে চাপ দিয়ে ইশারা করে সাহস দিলো।
বাদল মোমেনার বড় ভাই মফিজকে সালাম দিয়ে বলল, ‘ভাইজান, আপনি গ্রামে আসছেন, সোজা আমার বাসায় ওঠেননি কেন? এখানে থানায় এসে কষ্ট করলেন।’
মফিজ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কোন বাসায় ওঠব মিঞা? আমার বোনের বাসায় তো সে ছিল না, না থাকার কারণও তুমি। তুমিই মেরে বের করে দিসিলা। আর অন্য বাসা যেখানে আমার ভাইগ্না, ভাগ্নিকে আটকাইয়া রাখছ সেখানে তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!’
বাদল কী বলবে ভেবে পায় না। বোন যেমন বাকপটু, ভাইও তেমনি। এদের কাছে কথার জাল সব সময় তৈরি থাকে। যখন তখন ছুঁড়ে সামনের জনকে আটকে ফেলে। বাদলের কাছে কথাগুলোর জবাব আছে। কিন্তু সে ওইপথে গেল না। তার কাছে নিজের কথার মূল্য অনেক। উচিত সময় বুঝে তবেই সে কথা বলবে!
এসআই জলিল মামলার বিস্তারিত সব খুলে বলেন বাদলকে। তারপর জানতে চাইলেন, কেন সে মোমেনার গায়ে হাত তুলেছে! সে নিজে আইনের লোক হয়ে এমন জঘন্য একটা কাজ কী করে করতে পারল?
বাদল দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলে, ‘বিয়ের প্রায় সতেরো বৎসর হচ্ছে, মোমেনার গায়ে কখনো টোকা দিই নাই আমি! অথচ সে সব সময় আমাকে কষ্ট দিয়ে গেছে। মানসিকভাবে শান্তি দেয় নাই। আমাকে সব সময় সন্দেহ করে গ্যাছে। আমাদের বিয়ের কয়েক বছর পর থেকে বলা শুরু করল, আমি নাকি আরেকটা বিয়ে করছি। যেখানে আমার চাকরি সেখানে বাসা নিয়ে আরেকটা বউ রাখসি। আমি ওকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারতাম না যে, আমার আর কোনো বউ নাই। এটাও বলতাম যে ঠিক আছে, আমার চাকরি যেখানে সেখানে চলো। সেখানে বাসা নিয়ে একসাথে থাকব। কিন্তু বাচ্চাদের অসুবিধা হবে, ওর অসুবিধা হবে এই রকম নানা অজুহাতে সে রাজি হইতো না। আবার এদিকে আমাকে মিথ্যা মিথ্যা সন্দেহ করত যেগুলোর কোনো ভিত্তি নাই।
এগুলা ছাড়াও সে প্রচুর মিথ্যা কথা বলত। উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে সব সময়। আমি প্রথমবার যেদিন বুঝতে পারসি মিথ্যা বলাটা ওর রোগ তখন এটা নিয়ে চিন্তা করাও বাদ দিসি। আমার ঘরে আমি একটা জড় পদার্থের মতো হয়ে থাকতাম। তারপরও এই মহিলা শান্তি দিলো না। আমার বাচ্চাদের কানে কী যে কুমন্ত্রণা দিত কে জানে, ওরা আমার কাছে আসতে চাইত না। যেসব কাজ আমি পছন্দ করতাম না, যে কাজগুলা ভালো না সেগুলাই বেশি বেশি করে বাচ্চারা। ঘরটা জাহান্নাম বানাই ফেলসে।
আজকাল দেখি ঘরের জিনিসপত্র গায়েব হয়ে যায়। মোমেনা, আর নয়, বারো, চৌদ্দ, ষোলো বছরের চারটা বাচ্চার জন্য পনেরো দিনে পঞ্চাশ কেজি চাল লাগে? আট লিটার তেল লাগে? এই জিনসগুলা এরা খায় নাকি এগুলো দিয়ে গোসল করে আমি বুঝি না! এই বিষয়টাই জানতে চাইছিলাম। তখন মোমেনা চেঁচামেচি শুরু করছিল। কী করব ভেবে না পেয়ে একটা থাপ্পড় দিসি শুধু!’
এতটুকু বলে বাদল চুপ করল। জলিল সাহেব কথা শুরু করতে যাবেন সে সময়ে বাদল আরও কিছু বলার অনুমতি চাইল। এতকাল মনের ভেতর একটা দুঃখের সিন্ধুক লুকিয়ে রেখেছিল বাদল। আজ সেটার তালা খুলে দিতে চায় সে। কথায় কথায় কত কথা বলে ফেলল! কীভাবে মোমেনাকে বিয়ে করেছে, বিয়ের পর কী কী হয়েছে সব! মোমেনা মাঝখানে একবার মুখ খুলতে চেয়েছিল। জলিল সাহেব হাত উঁচিয়ে তাকে বাধা দেয়। সবাই চুপচাপ বাদলের কথা শুনতে থাকে।
মোমেনার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ছিল ওমান প্রবাসী। বিয়ের দুসপ্তাহের মাথায় সে ওমানে পাড়ি জমায়। এরপর আর ফেরেনি। পাঁচ-ছয় মাস পর চিঠি দিয়েছিল লোকটা, মোমেনার মতো বেয়াদপ কিসিমের মেয়ের সাথে সংসার করা সম্ভব নয় তার। সাথে সাথেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতারিত হয় মোমেনা। যে মেয়েকে স্বামী রাখতে চায় না, সেই মেয়ের আর কী প্রয়োজন?
এই কথাগুলো অবশ্য মোমেনা বাদলকে বলেনি। বলেছিল, তার স্বামী পুরুষত্বহীন। প্রথমে বাদলের করুণা হয় মোমেনার প্রতি। এরপর তার কথার কারুকার্যে সে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে থাকে। তারপর একদিন বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে মোমেনাকে বিয়ে করে সে। বাহাদুর মাস্টার তখন মান-সম্মান বাঁচাতে পাড়া প্রতিবেশিকে দাওয়াত খাইয়ে পুত্রবধূকে ঘরে তোলেন।
বছর না পেরোতেই একদিন বাদল জানতে পারে মোমেনার প্রথম স্বামী দেশে এসেছে। আরেকটা বিয়ে করেছে। সেই ঘরে একটা ছেলেও হয়েছে। বউ ছেলেকে ওমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করছে। সেই লোকের সাথে ঘটনাক্রমে বাজারে দেখা হয় বাদলের। জানতে চায় কেন ওভাবে মোমেনাকে ফেলে চলে গিয়েছিল। লোকটা বলেছিল, ‘এখন তো আপনার ঘরনি হয়ে গেছে। আপনিই বুঝবেন। আমি আর কী বলব?’
সেই থেকে বাদল বুঝেই চলেছে। এখনো শেষ হয়নি। কারেন্ট জালে জাটকা মাছের মতো আটকা পড়েছে যেন। কোনোভাবেই বের হতে পারছে না। একটু মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত প্রাণটা হাঁসফাঁস করছে তার।
বাদলের কথা শেষ হতেই মফিজ ঝাঁপিয়ে পড়লেন যেন, ‘বিচার নিয়া আসছি আমরা আর আপনি আমাদের কথা তো শুনলেনই না!’
জলিল সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ এবার আপনারা বলেন।’
মফিজ মোমেনাকে মাথা কাত করে, চোখ টিপে কয়েক রকমের ইশারা করলেন।
মোমেনা বলতে শুরু করেছে, ‘উনি আগে এমন ছিল না। আমাকে খুব ভালোবাসতেন। দুই বছর আগে আরেকটা মেয়েকে বিয়া করসে। এরপর থেকে আমাদেরকে আর দেখতে পারে না। আমাদেরকে নানাভাবে কষ্ট দেয়। খাবার-দাবার, কাপড়-চোপড় আগের মতো দেয় না। আমি এটা নিয়ে প্রতিবাদ করসি এজন্যই আমাকে মারসে। আমার সারা গায়ে মাইরের দাগ বসে গেসে।’
বাদল চমকে উঠে মোমেনার দিকে তাকায়। এসব কী বলছে সে! শুধুমাত্র একটা চড়ে সারা শরীরে দাগ হয়ে যায়? সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, জলিল সাহেব আবার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়। এটা দেখে মফিজ আর তাহের নূরী মুচকি হাসে।
দুপক্ষের বয়ান শুনে জলিল সাহেব বলেন, ‘আপনাদের সব কথা শুনেছি। এখন আমাকে বলেন আপনারা কি একসাথে থাকতে চান? সংসার টিকিয়ে রাখতে চান?’
মোমেনা আর বাদল সমস্বরে হ্যাঁ বলে। জলিল সাহেব খুশি হন। বলেন, ‘ঠিক আছে! আজকে আপনারা যান। আগামী পরশুদিন আসবেন আবার। মোমেনা, আপনি আপনার স্বামীর কাছ থেকে কী কী প্রত্যাশা করেন সেসব একটা কাগজে লিখে আনবেন। আর বাদল, আপনিও মোমেনার কাছ থেকে কীরকম ব্যবহার আশা করেন সেগুলো লিখে আনবেন। আজকের মতো বৈঠক এখানেই শেষ।’
মফিজ, মোমেনা আর তাহের নূরী নিজেদের বিজয় হয়েছে ভেবে খুশি মনেই থানা ত্যাগ করল। অন্যদিকে বাদল ভাবছে, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই সংসার টিকিয়ে রাখতেই হবে! কিন্তু মোমেনাকেও সোজা করা উচিত। নাহলে বাদলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে কী অঘটন ঘটতে পারে সেটা তার নিজেরও জানা নেই। এটাই উপযুক্ত সময়, এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে মোমেনা সংযত হয়ে চলে!
(চলবে)
[কীওয়ার্ডস:
অবিচার [ অষ্টম পর্ব ] | সালসাবিলা নকি
অবিচার [ অষ্টম পর্ব ] : সালসাবিলা নকি
অবিচার [ অষ্টম পর্ব ] – সালসাবিলা নকি
ছোটোগল্প | অবিচার [ অষ্টম পর্ব ]
সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [ অষ্টম পর্ব ]
ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]