নিভৃত ভালোবাসা
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রীর ক্রাশ শোভন স্যার। আসাদুল হক শোভন। লম্বা, সুদর্শন। অর্থনীতি বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ সিজিপিএ পেয়ে পাস করে মাত্র শিক্ষকতায় নিযুক্ত হয়েছেন। বিয়ে করেননি, এখনই তোড়জোড় করে বিয়ের কথা ভাবছেন না। তবে ভালো মেয়ে পেলে বিয়ে করবেন। যখন তিনি ক্লাসে লেকচার দেন ছাত্রীরা হাঁ করে চেয়ে থাকে। কয়েকটা মেয়ে চিঠি, ফুল দিয়ে প্রপোজও করেছে। তিনি এসবকে প্রশ্রয় দেন না মোটেও। সেই মেয়েগুলোকে সবার সামনেই বকে দিয়েছেন।
তিনি যে পথ দিয়ে চলাচল করেন সেখানেই শুরু হয়ে যায় মেয়েদের ফিসফিস, কানাকানি, হাসাহাসি। শোভন এসব দেখতেন, শুনতে পেতেন তবে পাত্তা দিতেন না। এ সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই নিয়মটা ভেঙে যায় একটা মেয়ের আগমনে। সুবাহ, অনেকের মধ্যে অন্যরকম, একেবারেই আলাদা সে।
শোভন স্যার একদিন ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন। সুবাহ একাকি গাছের নিচে বসে বই পড়ছিল। অন্য মেয়েরা যেখানে আড্ডা দেয়, এই মেয়েটা সেখানে বই পড়ছে! শোভন স্যার অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। মেয়েটা একবারও চোখ তুলে তাকায়নি। যেটা একেবারেই অস্বাভাবিক। অন্য যেকোনো মেয়ে হলেই তাকাতো।
শোভন খেয়াল করেছে ক্লাসেও মেয়েটা বেশ মনোযোগী। লেকচার শোনে, নোট টুকে নেয়, অ্যাসাইনমেন্ট সময় মতো জমা দেয়। বন্ধু-বান্ধব আছে ওর। তবে সব সময় অযথা আড্ডা দেয় না। অন্যদের চেয়ে আলাদা বলেই শোভন ধীরে ধীরে সুবাহর প্রতি দুর্বল হতে শুরু করে। এবং একসময় বুঝতে পারে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে সুবাহর চেয়ে ভালো আর কেউ হবে না। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হবে বুঝতে পারে না শোভন। শিক্ষক হয়ে ছাত্রীকে প্রপোজ করলে কেমন দেখায়! সবাই যখন জানবে তখন নিশ্চয়ই হাসাহাসি করবে।
দোটানায় ভুগতে থাকে শোভন। এদিকে দিনের পর দিন সুবাহর হাসি, কথা বলা, তাকানো সব বুকের মাঝে ব্যথার মতো বাজতে থাকে। এভাবে চারটি বছর কেটে যায়। সুবাহ অনার্স ফাইনালে ডিপার্টমেন্টে থার্ড হয়েছে। মিষ্টি নিয়ে আসে তারই প্রিয় শোভন স্যারের রুমে।
‘স্যার আসবো?’
শোভন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। আকাশনীল শাড়ি পড়েছে সুবাহ। চুলে বেলী ফুলের মালা। হাতে মিষ্টির প্যাকেট।
‘এসো এসো।’
‘স্যার আমার নিজের হাতে বানানো মিষ্টি। সবার জন্যই এনেছি।’
শোভন হাসলো।
‘বাহ্ তুমি মিষ্টিও বানাতে পারো।’
সুবাহ হেসে মাথা নাড়লো। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। তখনই শোভন থামালো তাকে।
‘সুবাহ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
সুবাহ বলে, ‘জি স্যার বলুন।’
‘তোমাকে চার বছর ধরে দেখছি। অন্য মেয়েদের থেকে অনেক আলাদা তুমি। তোমার নম্রতা, শালীনতা, মার্জিত আচরণ সব সময় আমাকে মুগ্ধ করেছে। গত চারটা বছর আমি তোমাতে মুগ্ধ হয়েই আছি। অনেকবার বলতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি কী ভাববে, অন্যরা জানলে কী ভাববে, শিক্ষক হয়ে আমি ছাত্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই লজ্জায়, দ্বিধায় তোমাকে কখনো বলতে পারিনি আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি। আজ বলছি, কারণ তোমার যদি আপত্তি না থাকে তবে তোমার বাসায় আমি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই।’
সুবাহর মনে হলো ওর মাথায় যেন কেউ আঘাত করেছে। এক পা দু’পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো সে। শোভন খুবই অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। নিজেকে ধীক্কার জানাচ্ছে সে। হয়তো সুবাহ কষ্ট পেয়েছে। এটা ভেবে সে সুবার কাছে গিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম সরি, সুবাহ। প্লিজ কেঁদো না। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। বিশ্বাস করো। আমি শুধু আমার মনের কথাগুলোই বলেছি। আমার আসলে কথাগুলো বলাই উচিত হয়নি।’
হঠাৎ সুবাহ শোভনের বুকে আঁচড়ে পড়ল। দুহাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শোভন কিছুই বুঝতে পারছে না সুবাহ কেন এমন করছে। তারপর কিছুটা ধাতস্ত হয়ে শোভনের বুক থেকে মাথা তুলল সুবাহ। চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘আপনি কথাগুলো বলতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আগামী মাসের ছয় তারিখ আমার বিয়ে।’
এবার শোভনের ওপর যেন বজ্রপাত হলো। কোনোমতে সামলে নিয়ে বলল, ‘বিয়েটা কি করতেই হবে? বন্ধ করা যায় না?’
‘না। সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। আত্বীয়-স্বজনকে বলা হয়ে গেছে। বিয়ে বন্ধ করে আমার পরিবার, ছেলের পরিবার এতগুলো মানুষকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। যদি মনে এতটুকুও আশা থাকতো আপনি কোনো একদিন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবেন তাহলে আমি কিছুতেই এই বিয়েতে রাজি হতাম না।’
শোভন জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি এতক্ষণ কাঁদছিলে কেন?’
সুবাহ শোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কারণ আমিও আপনাকে ভীষণ পছন্দ করি। ভালোবাসি। অন্যদের মতো আপনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম না। যদি এতে আপনি আমাকে খারাপ ভেবে বসেন? আমি আপনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি। কোনো কারণে যদি আপনি আমাকে অপছন্দ করেন, রাগ করেন আমার ওপর, এটা আমি চাইতাম না। এজন্য নিজের ভালোবাসাকে স্বযত্নে মনের মাঝে লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর এটা ঘুণাক্ষরেও মনে আসেনি যে আপনিও আমাকে পছন্দ করতে পারেন। তাই মনের কথা মনেই চেপে রেখেছিলাম চারটা বছর।’
শোভন সুবাহর দুহাত ধরে বলে, ‘তাহলে বিয়েটা করো না। সুখী হবে না তুমি। যাকে বিয়ে করছো সেও সুখী হবে না।’
‘বলেছি তো খুব দেরি হয়ে গেছে। আপনি যদি আরও আগে বলতেন তাহলে সবকিছু অন্যরকম হতো। এখন বিয়ে বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। নিজের সুখের জন্য এতগুলো মানুষকে দুঃখ দিতে আমি পারব না।’
সুবাহ নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তারপর বলে, ‘ভালোবাসা মানেই নিজের করে পাওয়া নয়। না পাওয়ার নামও ভালোবাসা। আমি যাকে খুব শ্রদ্ধা করি, যে আমার জীবনের আদর্শ, যার জন্য ভার্সিটির সব মেয়েরা পাগল তিনি আমাকে ভালোবাসেন এটা ভেবেই আমার সুখ লাগবে। আর এ সুখকে সঙ্গী করেই আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবো। আসি স্যার। ভালো থাকবেন।’
সুবাহ চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে শোভন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল, ‘আমার ভাগ্যে তোমাকে পাওয়া ছিল না। তাই হয়তো সঠিক সময়ে না বলে এত দেরি করে তোমাকে মনের কথাগুলো বলেছি। যদি আরও অনেক আগে বলতাম, তুমি আমার হতে। তুমি এখন অন্য কারও হবে। আমার ভাগ্যে ছিল তোমার দু-মিনিট আমাকে জড়িয়ে ধরা। এই স্মৃতিটা নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে আমাকে।’
নিভৃত ভালোবাসা | © সালসাবিলা নকি
আরও পড়ুন: অগল্প আগল্প ইগল্প
কীওয়ার্ডস: [ নিভৃত ভালোবাসা – সালসাবিলা নকি , নিভৃত ভালোবাসা , সালসাবিলা নকি , গল্পীয়ান , অণুগল্প , প্রেমের গল্প , রোমান্টিক গল্প , বিয়োগাত্মক গল্প ]
Pingback: অবিচার [চতুর্থ পর্ব] | সালসাবিলা নকির ধারাবাহিক ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: অবিচার [তৃতীয় পর্ব] | সালসাবিলা নকির ধারাবাহিক ছোটগল্প | গল্পীয়ান
Pingback: অবিচার [দ্বিতীয় পর্ব] | সালসাবিলা নকির ধারাবাহিক ছোটগল্প | গল্পীয়ান
Pingback: অবিচার [প্রথম পর্ব] | সালসাবিলা নকির ধারাবাহিক ছোটগল্প | গল্পীয়ান | Golpiyan
Pingback: একা (উপন্যাস) | মৌলী আখন্দ | রিভিউ: সালসাবিলা নকি | গল্পীয়ান | Golpiyan