অবিচার [ শেষ পর্ব ]_সালসাবিলা নকি

অবিচার [শেষ পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

ষষ্ঠ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

সপ্তম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

অষ্টম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

নবম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দশম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

এগারো পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

বারো পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তেরো পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চৌদ্দ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

পুলিশ অফিসার এসআই জলিল পান চিবোচ্ছেন। সব সময় তিনি পান খান না। শুধুমাত্র জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাকে পান খেতে হয়। পান চিবোনোর ফলে মুখের নড়াচড়ার সাথে মাথাও ভালো কাজ করে। আর রসটা যখন গিলে ফেলা হয় তার মনে হয় সেটা গলা দিয়ে নেমে যাচ্ছে না, সোজা মাথায় চলে যাচ্ছে। তখন তার মাথা কাজ করে ভালো।

জলিল সাহেবের সামনে মফিজুর রহমান বসে আছেন। তাদের দুজনের মাঝে একটা মোটা টাকার বান্ডিল। টাকাটা মফিজুর রহমান জলিল সাহেবকে দিচ্ছেন। তিনি যেন যেভাবেই হোক বাদলকে বাধ্য করেন তালাকনামা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য।

সেই টাকার বান্ডিলের দিকে তাকিয়ে জলিল সাহেব ভাবছেন কী করা উচিত। এখানে বিশ হাজার টাকা আছে।

জলিল সাহেব মফিজকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি তো ইমাম সাহেব। ধর্মের জ্ঞান আমার চাইতেও আপনার অনেক বেশি। দেখি বলেন তো, ঘুষ দেওয়া ও নেওয়ার ব্যাপারে ইসলামি শরিয়ত কী বলে?’

মফিজুর রহমান তার বিখ্যাত তেলযুক্ত হাসি দিয়ে বললেল, ‘কী যে বলেন স্যার! এইটা ঘুষ হবে কেন? উপহার দিচ্ছি আপনাকে।’

জলিল সাহেব কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে উপহার দেবেন ক্যানো? আমি কি আপনার আত্মীয় লাগি? আর এইরকম উপহার দেওয়াকেই তো ঘুষ বলে।’

‘একটা সংসার বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করা অনেক সওয়াবের কাজ!’
‘যে সংসারে অন্যায়-অবিচার হয়, সেখানে সেটা রুখে দেওয়া আরও বেশি সওয়াবের কাজ না?’

জলিল সাহেবের কথায় মফিজ হাঁ হয়ে থাকে। কী বলবেন বুঝতে পারেন না। জলিল সাহেবই আবার বলেন, ‘আপনার উপহার আমি নেবো না। আরেকবার দেওয়ার চেষ্টা করলে ঘুষ দেওয়ার অপরাধে আপনাকে হাজতে ভরব। সংসার যে করবে তাকে আমি সর্বোচ্চ বোঝানোর চেষ্টা করব। বুঝলে তো ভালো। না বুঝলে আমার আর করার কিছু নাই। কারণ স্পষ্ট, আপনার বোনের দোষ এখানে। সে-ই শর্ত ভঙ্গ করসে।’

তার এমন কঠিন কথায় মফিজ আর কিছু বলতে পারেন না। চুপ করে বসে থাকেন। এর একটু পরেই বাদল আসে থানায়। সে নির্ধারিত সময়েই এসেছে। মফিজই ঘুষ দেওয়ার জন্য আগেভাগে এসে পৌঁছেছিলেন।

জলিল সাহেব বাদলকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন। বাচ্চাদের ভবিষ্যতের চিন্তা করার কথা বলেন। বাদল বলে, ‘এই যে আপনি পান খেয়ে পিক ফেলতেছেন, আপনারে যদি বলি যে সেটা আবার মুখে তুলে নিতে, আপনি কি নেবেন? কক্ষনো নেবেন না। মোমেনাও আমার কাছে মুখের ফেলে দেওয়া থুতুর মতো। ওকে আবার গ্রহণ করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব না!

আর বাচ্চাদের কথা বলতেছেন? আমার ছেলে রবিকে শহরের নামকরা ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করায়ে দিসি। ওখানেই আবাসিক হোস্টেলে থাকবে সে। পিংকি, রিংকি আমার কাছে থাকবে। লিজা তো শহরের নামি প্রাইভেট কলেজে পড়ে। দামি হোস্টেলে থাকে। যেমন চলতেসে তেমনই চলবে সব। আমি আমার ওয়াইফকে ছাড়তিসি, বাচ্চাদেরকে না। ওদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব আমার কাছেই থাকবে। আমি এর একটুও অবহেলা করব না।

মোমেনার কাবিননামার অর্ধেক বিয়ের সময় দিছিলাম। আর অর্ধেক এখনই দিয়ে দেবো। কাবিননামার কাগজ ও টাকা আমি সাথে করে নিয়ে আসছি।’

একটু থেমে বাদল আবারও বলে, ‘সতেরো বছর ধরে আমি মোমেনার সব কিছু সহ্য করছি। এখন আর পারতিসি না। যদি ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করতেছে দেখতাম তাইলে আমার চাওয়া-পাওয়ার দিকে অত খেয়াল করতাম না। কিন্তু দেখতিসি বাচ্চাদেরকেও সে ভালো কিছু শেখাচ্ছে না। তাহলে আমি আর কীসের আশায় এই সংসার করব? মোমেনা শোধরাবে না। সে শোধরানোর মতো মেয়েই না।’

এরপরও অনেক কথা হলো, কথা কাটাকাটি হলো, কিন্তু বাদল তার সিদ্ধান্তে অটল। তাই ব্যর্থ মনোরথে মফিজকে থানা থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। মোমেনাও ছিল সাথে। ওকে আগে থেকেই মফিজ নিষেধ করেছিল যাতে থানায় কথা না বলে। তাই পুরোটা সময় চুপ ছিল সে। সে চেষ্টা করেছিল একটু কান্নাকাটি করতে। কিন্তু সারা জীবন তাকে কাঁদতে হয়নি। এজন্যই বোধহয় চেষ্টা করেও সে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে পারেনি।

মোমেনাকে মায়ের কাছে রেখে আসতে গেলেন মফিজ। খদিজা বেগম আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কান্না শুরু করেছেন, তখনই মফিজ ধমকে উঠল, ‘মাইয়ার তালাক হইছে সেইটা চিল্লাচিল্লি কইরা পাড়ার মানুষরে জানাই দিতেছেন, না?’

ধমক খেয়ে খদিজা বেগম হকচকিয়ে গেলেও মোমেনা ফোঁস করে ওঠে, ‘আম্মারে বকেন ক্যান ভাইজান? আমার আপন মা বইলাই কাঁদতেসে, আর আপনে তো খুউব খুশি হইসেন আমার তালাক হইসে তাই!’

মফিজ তার চোখ লাল করে তাকিয়ে থাকে মোমেনার দিকে। মোমেনা বলতে থাকে, ‘আপনার জন্যই হইসে সব। আপনার কারণেই আমার সংসার ভাঙছে। আমি যখন আপনার কাছে গেসিলাম তখন যদি আমারে বুঝাইতেন, আমারে শাসন করতেন, আমারে প্রশ্রয় না দিতেন তাইলে আজকে এই দিন আসতো না।’

মফিজ হতভম্ব হয়ে যায়। কী বলে এই মেয়ে! যার জন্য এত দৌড়াদৌড়ি, ছোটাছুটি করেছে সে কিনা তাকেই সবকিছুর জন্য দোষারোপ করছে! সে রেগে গিয়ে বলে, ‘চুপ কর বেয়াদপ। এখন বুঝতিসি তোর এই মুখের কারণেই বাদল তোরে তালাক দিসে। তুই সুখে থাকার জন্য এত কিছু করলাম আর এখন আমার সাথে বেয়াদবি করতেছস?’

‘আমারে বেয়াদব বলেন আপনার নিজের মাইয়া কী? আমার লিজা কুনোদিন বাপের নামে কিছু বলে নাই, কারও সাথে উঁচা গলায় কথা বলে নাই। আর আপনার মাইয়া… আমারে আর লিজারে যা না তা বলসে। অপমান করসে। সব মুখ বুঝে সইয্য করসি। ভাইঝি বইলা। সে যে আপনার নামেও কত বাজে কথা বলসে সেইগুলা কি আপনারে কুনোদিন বলসি আমি? আরও আমারে বেয়াদব বলেন!’

থমথমে কণ্ঠে মফিজ জানতে চায়, ‘শৈল আমার নামে কী বলসে?’

মোমেনা আরও অনেক আগেই চেয়েছিল শৈলীর নামে তার ভাইয়ের কান ভরবে। সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এখন তার নিজের সংসার ভেঙে গেছে। আর চুপ করে থাকা চলে না। তাই সে সেদিন ছাদে বলা শৈলীর কথাগুলো আরও অনেক তেল, নুন ও মসলা মিশিয়ে ভাইকে বলে।

মোমেনা বলে, ‘আপনি নাকি আজরাইলের চেয়ে কম না। সব সময় ওদের ওপর অত্যাচার করসেন। আর ওরা নাকি মুখ বুঝে সইয্য করে গেছে। শৈলী আর শিহাব চাকরি করলে নাকি আপনারে আর পাত্তা দেবো না।’

মোমেনা নিজ থেকেই অনেক কিছু বানিয়ে বলে। তার পুরোপুরি বিশ্বাস ভাইয়ের কারণেই তার সংসার ভেঙেছে। এখন ভাইয়ের সংসার ভাঙাটা তার গুরু দায়িত্ব।

মফিজ সব শুনে সাথে সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাগে তার পুরো শরীর কাঁপছে। এত্ত বড় সাহস শৈলীর! নিজের বাপের নামে বদনাম করেছে! তাও বাপের বোনের কাছে! মেয়েটার একটুও ভয় করেনি! আজকে বাড়িতে গিয়ে ওকে মেরেই ফেলবে!


শৈলী আগামীকালকের দিনটা নিয়ে ভাবছে। সোহেলের সাথে দেখা হবে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। এই অনুভূতির সাথে সে পরিচিত নয়। সোহেলের সাথে দেখা হবে, সে কী বলবে, সোহেল আসলে কেমন, কথা কেমন কেমন করে বলে… সারাদিন শুধু এসবই ভাবছে সে!

আছিয়া খাতুন দুশ্চিন্তায় দুপুরে খেতে পারেননি। মোমেনার বিষয়টা নিয়ে মফিজ গ্রামের বাড়ির থানায় গেছে। ওখানে কী হচ্ছে কে জানে! এমনিতে সংসারে অশান্তির শেষ নেই। এরমধ্যে যদি মোমেনার তালাক হয়েই যায় তাহলে অশান্তি বেড়ে দশগুণ হবে। আছিয়া খাতুন জায়নামাজে বসে প্রার্থনা করছেন, যা হয় তা যেন সকলের ভালোর জন্যই হয়।

সন্ধ্যের কিছুক্ষণ পরেই মফিজ ঘরে ফিরেছেন। তার থমথমে মুখ দেখেই আছিয়ার বুক শুকিয়ে গেল। নিশ্চয় খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলেন না। হাতমুখ ধুয়ে মফিজ বিছানায় শুলেন। আছিয়া খাতুন টোস্ট বিস্কুট দিয়ে এক কাপ চা দিলেন। তখনই মফিজ বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন, ‘চা দিছস ক্যান? আমি কি চা চাইছি?’

আছিয়া খাতুন কেঁপে উঠে বললেন, ‘বাইরে থেকে আসছেন কিছু খাইবেন না?’

মফিজ শোয়া থেকে মারমুখো হয়ে উঠে বললেন, ‘তোর (অশ্লীল শব্দ) খাবো, হারামজাদী…’

বলেই চুলের গোছা হাতের মুঠিতে নিয়ে আছিয়া খাতুনকে ধাক্কা মারলেন। তার মাথাটা গিয়ে দেয়ালের সাথে লাগল। তখন তার মনে হলো সবকিছু চড়কির মতো ঘুরছে। তিনি ঝাপসা দেখছেন। সেই অবস্থায় দেখতে পেলেন শৈলী এসেছে। দুইটা, তিনটা… অনেকগুলো শৈলী হলো কী করে!

শৈলী দৌড়ে এসে মাকে ঝাপটে ধরল। মফিজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আম্মুকে মারতেছেন ক্যানো?’

মফিজের কাঁধে তখন শয়তান ভর করেছে। দুই হাত দিয়ে ওদের দুজনের মাথা চেপে ধরে বাড়ি দিচ্ছে বারবার। তারপর ধাক্কা দিয়ে আছিয়া খাতুনকে সরিয়ে দিয়ে শৈলীকে উপর্যুপরি কিল, চড়, ঘুষি মারতে লাগল। আছিয়া খাতুনের তখন জ্ঞান হারানোর উপক্রম। সেই অবস্থাতেও তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘ওরে মাইরেন না। ওর শরীরে এই আঘাত সইব না। ছোড মাইয়া, ছাইড়া দেন ওরে।’

মফিজের কানে সেসব কিছু যাচ্ছে না। সে মার অব্যাহত রেখেছে, সেইসাথে গালাগাল করেই যাচ্ছে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, আমার বইনের কাছে আমার বদনাম করস? আমি আজরাইল? আজরাইল চিনস তুই? আইজকে চেনাবো তোকে। মাইরেই ফেলব।’

শৈলী মেঝেতে কুঁকড়ে থাকে, সারা শরীরে বৃষ্টির মতো মার পড়ছে, আর ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে বিজলির মতো। মফিজ মারতে মারতে বলছে, ‘তুই জন্মের পর থিকা আমার ক্ষতি করে যাচ্ছস। এখন আমার ক্ষতি করতছস, বিয়ার পর জামাইর ক্ষতি করবি। তুই জন্ম নিছস ক্ষতি করতে। আমার রক্ত না তুই। তোর মা জানে কোত্থেকে এই পাপ পেটে ধরসে।’

শরীরের ব্যথার চেয়ে বাবার বলা কথাগুলো আরও বেশি যন্ত্রণা দেয় শৈলীকে। সে যখন নিস্তেজ হয়ে আসে তখন মফিজ আবার আছিয়া খাতুনের কাছে যায়। মেঝেতে পড়ে ছিল সে। মফিজ তাকে লাথি মারতে মারতে বলে, ‘আমার বইনের তালাক হইসে না? তোরেও আমি তালাক দিয়ে দেবো। তখন দেখব তুই কোথায় যাস। তালাক দেবো তোকে, তালাক, তালাক, তালাক…!’

ঠিক সেই মুহূর্তে শিহাব ঢুকে বাসায়। টিউশনি থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ফিরেছে সে। ভেবেছে বাসায় পৌঁছেই সোজা বিছানায় শুয়ে যাবে। কিন্তু বাসার দৃশ্য দেখে প্রথমে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পেটে হাত দিয়ে গোঙাচ্ছে আর মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে শৈলী। একপাশে চুপচাপ পড়ে আছে তার মা। বাবা সমানে লাথি মেরে যাচ্ছে। প্রথমে শিহাবের মাথা কাজ করেনি। পরে সে কোনোরকম শব্দ না করে রান্নাঘরে চলে যায়। এদিক-ওদিক খুঁজে একটা রাম দা দেখতে পায় সে। সেটা হাতে নিয়েই মফিজের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। একেবারে শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমার আম্মুকে যদি আর একটাও মারেন, তাহলে এই দা দিয়ে আপনাকে টুকরা টুকরা করে ফেলব।’

ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে মফিজ। তারপর ছেলেকে কৈফিয়তের সুরে বলে, ‘শিহাব, বাবা তুমি জানো না, শৈল কী জঘন্য কাজ করসে। সব দোষ তোমার আম্মুর। ও শৈলকে বেয়াদব বানাইসে। শিক্ষা দিতে পারে নাই।’

শিহাব তেমনি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, ‘শৈল কী করসে সেটা আমি জানি না। কিন্তু আপনি কী করসেন সেটা আমি নিজের চোখে দেখসি, কী কী বলসেন সেটা নিজের কানে শুনসি। শৈল এমন কোনো অপরাধ করতে পারে না যার জন্য আপনি ওকে এভাবে মারবেন। আর আম্মুকে কী বলসেন সেগুলাও সব শুনসি আমি।’

মফিজ রক্তলাল চোখে তাকিয়ে থাকে। শিহাব মা আর বোনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

আছিয়া খাতুনের নড়াচড়া করার শক্তি নেই। শৈলী রাতের জন্য ডাল রান্না করে। আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি করে। রাতে মফিজ ছাড়া আর কেউই ভাত খেতে পারে না। মফিজ খেতে খেতে ভাবেন, ‘শৈল একটু-আদটু বেয়াদবি করলেও রাঁধে ভালো।’

সকালে ঘুম থেকে উঠেই মফিজ আগে গোসল করেন। তারপর ভাত খান। একটু টিভি দেখেন। এরপর পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। আজকে টিভির রিমোট নিয়ে আয়েশ করে যখন বসলেন তখনই দেখতে পেলেন আছিয়া খাতুন বোরখা পড়ছেন। কাল রাত থেকে কোনো কথা হয়নি তার সাথে। আছিয়া খাতুনও তাকে না বলে কখনো কোথাও যায়নি। মফিজ একটু অবাকই হলেন আছিয়ার এই স্পর্ধা দেখে।

কণ্ঠে যথেষ্ট রাগ নিয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কই যাস?’
আছিয়া খাতুন কিছু বলার আগেই শৈলী বলে ওঠল, ‘আম্মুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি আমরা।’
‘বেয়াদব মাইয়া, তুই চুপ থাক।’ গর্জে উঠেন মফিজ। শৈলী মাকে অনুনয়ের সুরে বলে, ‘আম্মু আজকেও চুপ থাকবেন? কিছু বলেন না ক্যানো?’

আছিয়া খাতুন হয়তো আজও কিছু বলতেন না। কিন্তু গতকাল মফিজ যা করেছেন এরপর আর চুপ থাকা যায় না। এত বড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলে তিনি অন্যায়ের চরম সীমা পার করে ফেলেছেন।

‘আপনি আমারে গতকাল তালাক দিসেন। সেই হিসেবে এখন আপনি আমার কাছে বেগানা পুরুষ মানুষ। একজন বেগানা পুরুষ মানুষের ঘরে আমি থাকব ক্যামনে? সেইজন্য চলে যাচ্ছি। আমার সাথে আমার ছেলেমেয়েও যাচ্ছে।’

অন্য সময় হলে এভাবে মুখের ওপর কথা বলার কারণে মফিজ সাথে সাথে কয়েকটা কিল ঘুসি দয়ে দিতেন। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। আছিয়া বোরখা পরে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। শৈলী আর শিহাবও তৈরি। মফিজ হঠাৎ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তিনি জীবনে যা করেননি তাই করতে বাধ্য হলেন। ছেলের হাত ধরে বললেন, ‘আব্বু আমাকে ভুল বুঝে এত বড়ো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললা। তুমিই তো আমার হাতের লাঠি। আমাকে ফেলে যাইও না আব্বু!’

বলেই কান্না করতে লাগলেন। সবাই-ই জানে এটা মফিজের অভিনয়। শিহাব ছেলে মানুষ, টাকা ইনকাম করে খাওয়াবে, বুড়ো বয়সে বাপকে দেখবে। এজন্য ছেলে চলে যাচ্ছে দেখে এখন ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা বুঝতে পেরেও শৈলীর খুব অভিমান হচ্ছে। মিথ্যে করে হলেও আব্বু এভাবে কখনো আদর করে কথা বলেনি তার সাথে। মেয়ে বলেই কি এত অবহেলা! গতকালকের বলা কথাগুলোও এখনো কানে বাজছে তার।

শিহাব বাবার নাকি কান্না আমলে নিল না, মাকে তাগাদা দিলো, ‘আম্মু চলেন।’

মফিজ এবার মরিয়া হয়ে বলেন, ‘তোমরা এমন করতেছ ক্যানো? আমি তো তালাক দিই নাই। তালাক বললেও রাগের বশে বললে তালাক হয় না!’

আছিয়া বলেন, ‘তালাক হয় নাই মনে করে থাকলে পরে এরকম আরও অনেক তালাক দেবেন। আর এইখানে থেকে মাইর খাওয়ার কোনো শখ নাই আমাদের।’

মফিজকে এড়িয়ে ওরা তিনজন দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। গাড়ি ছেড়ে দিতেই আছিয়া খাতুন কেঁদে ওঠলেন। শিহাব অবাক হয়ে বলল, ‘আম্মু এতদিন পর কারাগার থেকে মুক্ত হইলেন। আপনার তো খুশি হওয়ার কথা! কাঁদতেসেন ক্যানো? এটা কি খুশির কান্না?’

শৈলী বলে, ‘নারে ভাইয়া। এটা দুঃখের কান্না। আজ আম্মুর পঁচিশ বছরের সংসার ভেঙে গেছে।’

‘তো কী হইসে ভাঙসে? এইটা কোনো সংসার ছিল? আজকে আমরা যে কাজটা করসি সেটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু সাহস পাই নাই। মানুষ বদনাম করবে, থাকব কোথায়, খাব কী এসব ভেবে ভেবে আব্বুর সব অন্যায়-অবিচার সহ্য করে গেসি। এখন অবশেষে আম্মু মুক্তি পাইসে।’

শৈলী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। মনে মনে বলে, ‘তুই বুঝবি নারে ভাইয়া। নিজ হাতে গড়া সংসারের মায়া বড় মায়া। এটা শুধু মেয়েরাই বোঝে। হয়তো মেয়েরা সংসার সাজায় বলে।’

শৈলী আনমনা হয়ে ছিল, টুং করে মেসেজের শব্দে চমকে ওঠে। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সোহেল মেসেজ করেছে। লিখেছে, ‘কাল দেখা হবে। তার আগে একটা প্রশ্ন করি, পরী তুমি কি আমায় ভালোবাসবে?’

শৈলী সিমটা খুলে বাইরে ফেলে দিলো। ভালোবাসা-বাসি তার জন্য নয়। সামনের দিনগুলোতে তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হবে। আর এর শুরুটা হয়েছে আজ থেকেই। শিহাবের একটা স্কুলে চাকরি হয়েছে। ওর দুটো টিউশনি এখন থেকে শৈলী করবে। আগে বাবা শুধু বাসা ভাড়া দিত। খাবার খরচ ও অন্যান্য খরচ দিতে হতো শিহাবকে। এখন শৈলীও যদি টিউশনি করে ওরা তিনজন কোনোরকম চলে যেতে পারবে। একটু কষ্ট হবে হয়তো, তবু মানসিকভাবে তারা শান্তিতে থাকতে পারবে। আম্মু আর ভাইয়ার সাথে হাসিখুশি থেকে দিন কাটানোর জন্য অদেখা-অজানা একজন মানুষের ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে তেমন কোনো দুঃখ হচ্ছে না তার। কিন্তু চোখে কেমন যেন জ্বলছে। টুপ করে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে ফেলে শৈলী। চলন্ত গাড়ির বাতাসের কারণে হয়তো এমন হচ্ছে, মনকে এভাবেই প্রবোধ দেয় সে।


গাইনি ডাক্তার রোখসানা পারভিনের চেম্বারে বসে আছে কোহিনূর। অবাক হয়ে চারদিকে দেখছে। জীবনে এই প্রথম সে শহরে এসেছে, তাও এত বড়ো একজন ডাক্তারকে দেখাতে। বিশ্বাসই হতে চাইছে না তার। রোখসানা পারভিন সরাসরি বাদলকেই বললেন, ‘পরীক্ষা করে দেখলাম ওর জরায়ু নেই। সব মেয়েদেরই থাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা হলে, কোনো কোনো মেয়েকে তিনি বঞ্চিত করেন। সে যখন তার মায়ের গর্ভে ছিল তখন অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি হওয়ার সময় জরায়ু তৈরি হয়নি। এর অর্থ হলো কোহিনূর কখনো মা হতে পারবে না। এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু এটার জন্য দাম্পত্য জীবনে কোনো সমস্যা হয় না।’

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে আসে কোহিনূর আর বাদল। বাদলের মুখে অমাবস্যার অন্ধকার। কোহিনূর জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি এত মন খারাপ করতেছেন ক্যান? ডাক্তার আফা তো বলসে, এইটার জন্য কোনো সমস্যা হইব না। শুধু আমার প্যাটে বাচ্চা আসব না এইটাই।’

বাদল কোহিনূরের মুখের দিকে তাকায়। কী সহজ-সরল চাহনি! এই মেয়েটা সবার ভালো চায়, সবার ভালো করে, সকলের ভালোবাসা পায়ও সে। অথচ তার ভাগ্যে মেয়েদের সবচেয়ে বড় সুখটাই নেই। মা হওয়ার সুখ।

বাদল জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার খুব কষ্ট হইতেছে না?’
কোহিনূর অবাক হয়ে বলে, ‘কষ্ট হইব ক্যান?’
‘তুমি যে মা হইতে পারবা না?’

বাদলের ওই কথাটা শুনে এবার সত্যি সত্যিই মন খারাপ হয় কোহিনূরের। ছলছল চোখে বলে, ‘জন্ম দিই নাই বইলা কি আমি আপনার পোলা-মাইয়ার মা হইতে পারব না? সেই যোগ্যতা কি আমার নাই?’

বাদল কপাল কুঁচকে ফেলে। বোঝার চেষ্টা করে কোহিনূর কী বলছে। কোহিনূর ঠোঁট চেপে ধরে কান্না প্রতিহত করার চেষ্টা করে বলে, ‘আমি কি লিজা, রবি, রিংকি, পিংকির মা হইতে পারব না? আমি তো ওদের মায়ের মতোই ভালোবাসার চেষ্টা করি। ওদের আদর-যত্নও ঠিকঠাক করব। তবু কি ওদের মা হইতে পারব না?’

বাদল এবার বুঝতে পেরে হো হো করে হেসে ফেলে। তারপর পরম মমতায় কোহিনূরের মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে বলে, ‘পাগলি, তুমি তো ওদের মা-ই… মা হওয়ার যোগ্যতা ওদের জন্মদাত্রী মায়ের চেয়েও তোমার বেশি!’

হাসপাতালে আগত অন্যান্য রোগীর আত্মীয়-স্বজন সবাই বাদল আর কোহিনূরকে দেখছে। দুজনেরই চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। মাত্রই গাইনি ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়েছে। সবাই ভাবছে নিশ্চয় ডাক্তার সুখবর দিয়েছে, নতুন অতিথি আসছে হয়তো তাদের ঘরে। ওদের খুশি দেখে তাই অন্যদের ঠোঁটেও হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।

মানুষ প্রায়ই বলে আল্লাহ এটা দেয়নি, ওটা দেয়নি, সবাইকেই দেয় তাকেই দেয়নি শুধু, তার প্রতি অবিচার করেছে ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি…! আসলে স্রষ্টা কারও প্রতিই অবিচার করেন না। সবাই তাঁরই সৃষ্টি। তিনি সবাইকেই সমান ভালোবাসেন। কাউকে বেশি, কাউকে কম; এমন না! কাউকে কিছু কম দিলে অন্যদিকে ভরিয়ে দেন। মানুষই সেটা বুঝতে পারে না। যা পেয়েছে তা চোখ মেলে দেখে না, যা পায়নি তার পেছনেই ছোটে, আফসোস করে মরে।

বাদল কোহিনূরকে পেয়েও প্রথমে তার মূল্য বুঝতে পারেনি। কোহিনূর অনেক কিছু হারিয়েছে, আবার যা পেয়েছে তা নিয়েই খুশি হয়েছে। তাই সে সত্যিকার অর্থেই সুখীদের একজন। এখন বাদলও সে সুখের পরশ পেয়েছে।

অন্যদিকে, মফিজ আর মোমেনার মতো মানুষ, যারা অন্যদের সাথে অবিচার করে; স্রষ্টা তাদের সাথেও অবিচার করেন না, তিনি ন্যায়বিচার করেন!

[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ শেষ পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ শেষ পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ শেষ পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [ শেষ পর্ব ]

অবিচার [ শেষ পর্ব ] | ছোটোগল্প

অবিচার [ শেষ পর্ব ] – ছোটোগল্প

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [ শেষ পর্ব ]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: