অবিচার [ ষষ্ঠ পর্ব ]

অবিচার [ষষ্ঠ পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চারপাশে বাঁশের বেড়া, ওপরে বাঁশের চাটাই, তার ওপর টিন দিয়ে তৈরি বাদলের ছোট বউ কোহিনূরের ঘর। দিনের বেলা প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার মতো গরম লাগে। রাতের বেলাও গরম কমে না। সারা দিনের সূর্যের রোদ যেন টিনের চালে জমা হয়। রাত হলেই সেই গরম হামাগুড়ি দিয়ে ঘরের ভেতরে নেমে আসে।

সবচেয়ে বড় কথা এই বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই। বাদল এখানে কখনোই থাকে না। মোমেনার ওপর জেদ করেই সে কোহিনূরকে বিয়ে করেছিল। আরেকটা বউয়ের প্রয়োজন, এই কারণে নয়! ছুটিছাটাতে গ্রামে আসলে মোমেনার জন্য করা পাকা বাড়িতে ওঠে সে। কোহিনূরকে কিছু বাজার-সদাই করে দেয়। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে। এতটুকুই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে বেরিয়ে যায়।

এই অল্প সময়ে কোহিনূর সারাক্ষণ হাত পাখা নিয়ে বাদলকে বাতাস করতে থাকে। বিয়ের প্রায় দেড়-দুই বছর হতে চলল। কোহিনূর কখনো মুখ ফুটে কিছু চায়নি। বরং তার হাবভাব দেখে মনে হয় সে বাদলকে কিছু দিতে পারলেই খুশি। কিন্তু বাদলের কোনো কিছু চাওয়ার নেই। তার সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-প্রত্যাশা মোমেনার কাছে। পৃথিবীর অলিখিত নিয়মই বোধহয় এটা- ‘যার কাছে চাই, তার কাছে পাই না! যার কাছে চাওয়ার কিছু নেই, সে উজাড় করে দিতে প্রস্তুত!’

বাদলের ছোটো দুই মেয়ে রিংকি, পিংকি ও ছেলে রবিকে সে ছোট বউয়ের কাছে নিয়ে এসেছে গতকাল বিকেলেই। সারারাত কোহিনূর বসে থেকে বাচ্চাদের বাতাস করেছে। যাতে বাচ্চাগুলো গরমে কষ্ট না পায়। আর তখনই বাদলের খেয়াল হলো, থাকার জন্য সে কোহিনূরকে স্থান দিয়েছে। কিন্তু সেটাকে বাস করার উপযোগী করে দেয়নি। অথচ কোহিনূর কোনো দিন এই ব্যাপারে অসন্তুষ্টি দেখায়নি। যত অসন্তুষ্টি সব মোমেনার কাছে। সব দেওয়ার পরও, এটা নেই, ওটা নেই! নেই এর লিস্ট সব সময়ই এক হাত লম্বা থাকে মোমেনার। বাদল আশ্চর্য হয়, মানুষে মানুষে এত তফাত কেন!

কোহিনূর বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে নাস্তা খেতে দিয়েছে। তিন জনকে তিনটা ডিম পেয়াজ, মরিচ দিয়ে ভেজে দেওয়া। সাথে রুটি। বাদলের জন্যও একই ব্যবস্থা। বাদল বাজার করেনি। বাসায় ডিম থাকার কথা না। সে বিরক্ত হয়ে জানতে চায়, ‘কার থেইকা খুঁইজা ডিম আনলা আবার? রুটির সাথে আলু ভাজি দিলেই তো হইতো।”

কোহিনূর লাজুক হেসে বলে, ‘কারও থাইকা খুঁজি নাই। আমার নিজের মুরগির ডিম এইগুলা। আপনি আমারে মাসিক যে বাজার দেন সেগুলা থেইকা অল্প-স্বল্প বাঁচে সব সময়। অগুলা বেইচা আমি মুরগির বাচ্চা কিনছিলাম ছয়ডা। তিনডা মইরা গেছে। আর তিনডা বাঁইচা আছে। অগুলা বড় হইসে। দুইডা মুরগিই ডিম দেয়। আরেকটা মোরগ। তিনডাই দেখতে মাশাআল্লাহ অনেক মোটাসোটা হইসে!’

কথাটা শুনে বাদল বিস্ময়ে হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ! বলে কী এই মেয়ে! বেঁচে যাওয়া বাজার-সদাইয়ের বিনিময়ে মুরগি ছানা কিনেছে! এত সংসারী কোহিনূর! অথচ সে এতদিন পর বুঝতে পারল! তখনই মোমেনার কথা মনে পড়ল বাদলের। কোথায় মোমেনার চিন্তাধারা আর কোথায় এই কোহিনূরের চিন্তাধারা!

মোমেনার কথা মনে হতেই লিজার কথা মনে আসলো বাদলের। লিজা কোথায় আছে সে জানে না। কাল যে রাগ করে লাথি দিয়ে চলে এসেছিল, এরপর আর ফিরেও তাকায়নি। খোঁজও নেয়নি। একটা বাড়ন্ত মেয়ে এক রাত কোথায় থাকল, এক জন বাবার কাছে এটা অনেক বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু বাদল সেই দুশ্চিন্তা করছে না, বরং গতকালের রাগ তার কিছুমাত্র কমেনি।

লিজা তার নানির কাছেই থাকবে এটা জানা আছে বাদলের। বউ, ছেলে-মেয়েদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভেবে শাশুড়ির পাশে বাসা করে দিয়েছিল। বাদল সব সময়ই পরিবারের সুখের চিন্তা করে এসেছে। কিন্তু বিনিময়ে পরিবারের কাছ থেকে সে কী পেয়েছে? এ হিসেব মেলাতে গেলে বড্ড গোলমেলে লাগে বাদলের।

তার খুব ইচ্ছে ছিল সন্তানেরা তার আদর্শে বড় হবে। মোমেনার মতো হবে না। মোমেনা কথায় কথায় মিথ্যে বলে। মিথ্যে বলা তার রোগে পরিণত হয়েছে যেন। সামনাসামনি এত জোর দিয়ে মিথ্যে বলে যে, বাদলের তখন মনে হয় মোমেনাই ঠিক। কিন্তু সত্য ঘটনাটাও বাদলের ভালোই জানা থাকে। সেই মুহূর্তে নিজেকে পাগল পাগল মনে হয় বাদলের।

গতকাল যে ঘটনাটা ঘটেছিল তাও মোমেনার কারণেই। মাসের অর্ধেকে এসে সে বলে মুদি বাজার শেষ। আবারও এনে দিতে হবে। বাদল অবাক হয়ে যায়। পুরো মাসের বাজার এই অল্প দিনে কীভাবে শেষ হয়!

হিসেব চাইতে গেলে মোমেনা অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শুরু করে, ‘হ, এখন তো হিসাব চাইবাই। আরেকটা সংসার হইসে, হিসাব চাইবা না? সব তো এখন অইখানেই দাও। আমি আর আমার বাচ্চারা যে না খাইয়া থাকি সেটার খেয়াল তোমার ক্যামনে থাকব?’

বাদল আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘না খাইয়া থাকতে হইব ক্যান? আমি তো পুরা মাসের বাজার একসাথে করে দিসি। ৫০ কেজি চাল, ৮ লিটার তেল, ডাল, দুধ, চিনি সব তো দিসি পুরা মাসের জন্য। বাচ্চারা এখনো ছোটো। তারা কতগুলান খায় তা আমি দেখি না? এতগুলা জিনিস এত তাড়াতাড়ি ক্যামনে শেষ হইল সেটাই জানতে চাইছি।’

সাথে সাথে মোমেনা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আহাজারি শুরু করে, ‘ও আল্লাহ রে, আমারে এইদিন ক্যান দেখাইলা? কী দোষ করসে আমার মাসুম বাচ্চারা? কী দোষ করছি আমি? আমার অখন খাওয়ার খোটা শুনতে হইতেসে। আল্লাহ গো…’

বাদল প্রথমে স্তব্ধ হয়ে যায়। মোমেনার মিথ্যের সাথে সে পরিচিত। কিন্তু এখন কোথাকার কথা টেনে নিয়ে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে! আর যেভাবে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে, মানুষজন তামাশা দেখার জন্য ভীড় করবে। মান ইজ্জতের ভাবনা খুব টনটনে বাদলের। মোমেনার চেঁচামেচিতে পাড়াপ্রতিবেশী জড়ো হলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে। কী করবে ভেবে না পেয়ে অতর্কিতে একটা চড় বসিয়ে দেয় মোমেনার গালে। মোমেনা বিয়ের সতেরো বছরে এই প্রথম স্বামীর হাতের মার খেয়েছে। গলা থেকে আর একটা স্বরও বের হয়নি তার।

এরপর তিলমাত্র বিলম্ব না করে বাদল বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। যদিও রাতে এখানেই থাকার ইচ্ছে ছিল। মোমেনার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। মোমেনাও বাধা দেয়নি। মনে মনে বলেছিল, ‘ওই মাগির কাছে থাকবি তো। যা থাক গা। কয়দিন থাকস আমিও দেখব। আমারে অশান্তিতে রাইখা তুই শান্তিতে থাকবি, সেটা হইব না।’

মোমেনা তখনই ঠিক করেছিল, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়েই সে বড় ভাইয়ের বাসায় যাবে। বাদল একটা চড় দিয়েছে তাকে, এর বিনিময়ে বাদলকে সে সাতটা চড় খাওয়াবে। মোমেনা যে শুধু মিথ্যে বলে তা না। মুখেরও লাগাম নেই। যা তা বলে বসে, গালিগালাজ করে। পরপুরুষের সাথে রং-ঢংও করে। বাচ্চাগুলোও হয়েছে মায়ের মতো।

লিজার অবস্থা কাল নিজের চোখে দেখেছে বাদল। বাবা হয়ে মেয়েকে ওই অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারেনি। তাই কোনোকিছু না ভেবেই লাথি দিয়েছিল। এখন মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। রিংকি ক্লাস নাইনে পড়ে এখন। এখনই প্রচুর মিথ্যে বলে মেয়েটা। অনেক বার ধরা পড়েছে। আল্লাহ খোদার নামে শপথ করেছে, আর জীবনেও মিথ্যে বলবে না! একটু পরেই আবার আরেকটা মিথ্যে কথা! দেখতে লিজার মতো লম্বা, কিন্তু চোখে পড়ার মতো সুন্দরী না, রিংকি! তবুও ভয় হয় বাদলের। সেও কি বড় বোনের পথ ধরবে?

লিজার রাশ টেনে ধরার সময় নেই আর! কিন্তু বাকি তিন জনকে এখনো ভালো পথে আনা যাবে। কিন্তু ওরা মায়ের সাথে থাকলে একেকটা অমানুষ হয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। বাদল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে- রিংকি, পিংকি ও রবিকে কোহিনূরের কাছেই রাখবে সে। তার আগে এই ঘরে ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরদোরও ঠিক করতে হবে। এসব ভেবে বাদলের মন অনেকটাই হালকা হয়ে যায়। ফুরফুরে মন নিয়ে বাইরে যায় সে। সামনে অনেক কাজ আছে বাদলের!

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ ষষ্ঠ পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ ষষ্ঠ পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ ষষ্ঠ পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [ষষ্ঠ পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [ষষ্ঠ পর্ব]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: