অবিচার [ সপ্তম পর্ব ]

অবিচার [সপ্তম পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

চতুর্থ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

পঞ্চম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

ষষ্ঠ পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

কিছু মানুষ আছে যারা কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই অন্যায় করে বা খারাপ কাজ করে থাকে। তারা তাদের কাজের পেছনে একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করায় এবং প্রমাণ করতে চায় যে, সে যা করেছে সেটাই ঠিক। লিজাও এখন তার কৃতকর্মের ব্যাখ্যা সাজাচ্ছে। সে মোটামুটি শক্ত যুক্তি বের করার চেষ্টা করছে, সে যা করেছে তা অযৌক্তিক কিছু না।

ইদানীং সে প্রেম করছে। তাদের এলাকারই একটা ছেলের সাথে। ছেলেটার নাম তুহিন। সিটি কলেজে পড়ে। লিজাদের বংশ ভালো। দাদা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এলাকায় একনামে পরিচিত, বাহাদুর মাস্টার। লিজার বাবার নাম ডাকও কম নয়। পুলিশের বড় অফিসার। এলাকায় তাদের বেশ সুনাম। কিন্তু তুহিনের বাপ-চাচা কেউ কখনো লেখাপড়ার ধারে-কাছে ঘেঁষেনি। দাদা হালচাষ করতেন, মানুষের বাড়িতে কামলা খাটতেন। তুহিনই একমাত্র ছেলে যে পড়াশোনা করছে।

লিজার নিজস্ব মত, যেসব পরিবারে অশান্তি চলে সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা শান্তি খোঁজার জন্য প্রেম করে। অনেকে অবশ্য আরও গর্হিত অপরাধ করে বসে। লিজা শুধুমাত্র একটা ছেলের সাথে প্রেমই করছে। এ কারণেই লিজার কাছে তার প্রেম সিদ্ধ। সে তার মা মোমেনাকেও জানিয়েছে। প্রথম দিন থেকেই মা রাজি আছে। বলেছে, ‘কর প্রেম কর। এই তুহিনের সাথেই কর। তোর বাপ বংশের গৌরব দেখায় না সব সময়? এইবার দেখব মান-সম্মান ক্যামনে ধরে রাখে!’

মায়ের এমন প্রতিশোধপরায়ণ কথায় লিজা আশ্চর্যান্বিত হয় না। মায়ের সব কথাকেই সে ঠিক মনে করে। আর বাবাকে ঘৃণা করে। কখন থেকে? লিজার নিজেরও ভালোভাবে মনে পড়ে না। চোখ বন্ধ করে যখন অতীতে ঘুরে আসে তখন আলোকিত দিনের বদলে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলোই দেখতে পায় সে। বাবার চাকরিটাই এমন যে, বছর বছর বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে হতো। কিন্তু তাদের কোনো সমস্যা হতো না। তারা গ্রামেই থাকত। বাবা আসতো দুই সপ্তাহ, তিন সপ্তাহ পর পর। মাঝে মাঝে তাদেরকে নিজের চাকরিস্থলে বেড়াতে নিয়ে যেত বাবা। এভাবেই লিজার আদিগন্ত সমুদ্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়। সিলেটের চা-বাগান, কাপ্তাই লেক, রাঙামাটির লাল পাহাড় এসব কিছুই দেখা হয়ে গেছে লিজার।

বাবা যখন বাড়ি আসতো সাথে থাকত দুহাত-ভর্তি জিনিসপত্র। আর নাম না জানা হরেকরকম খাবার-দাবার। বাবা যেদিন আসতো সেদিন ইদের দিনের মতো আনন্দময় হতো। কিন্তু বাবা যত খুশি নিয়ে আসতো নিজে তত খুশি থাকতে পারতো না। আসতে না আসতেই বাবা-মায়ের খিটমিট শুরু হয়ে যেত। তবে অধিকাংশ সময়েই বাবা চুপ করে থাকত। মা নানারকম খোঁটা দিয়ে কথা বলত, বাবা না-শোনার মতো করে থাকত। লিজার মনে হতো বাবা হয়তো অপরাধী তাই কোনো প্রতিবাদ করে না।

লিজা যখন ক্লাস নাইনে তখন একদিন জানতে পারে তার বাবা বিয়ে করেছে। যেই ভিখারিনী প্রতিদিন সবার ঘরে ঘরে ভিক্ষা খুঁজে ফেরে তার মেয়েকেই বিয়ে করেছে লিজার বাবা। রাগে অপমানে সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিল লিজা। এরপর থেকে বাবার প্রতি ঘৃণার মাত্রা এতই বেড়ে গিয়েছিল, সেখানে শৈশবের আনন্দের দিনগুলোর ছিঁটেফোটাও আর অবশিষ্ট রইল না। তার মাও প্রতিদিন নিয়ম করে মগজে ঢুকিয়ে দেয়, ‘প্রতিশোধ নিতে হবে।’ আর এই প্রতিশোধ নেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে পদে পদে বাবাকে অপমানিত করা।

গ্রাম্য সমাজ এখনো ছেলে-মেয়ে প্রকাশ্যে কথা বলার মতো আধুনিক হয়ে ওঠেনি। তাই লিজা তার প্রেমিকের সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য গাছের আড়ালকেই উপযোগী ভেবেছিল। কিন্তু তার চিরশত্রু বাবা সেখানেও হানা দেবে কে জানতো!

তুহিন ভয়ে পালিয়ে গেলেও মায়ের কাছ থেকে পাওয়া গোয়ার্তুমি স্বভাবের জন্য লিজা পালাতে পারেনি। একই কারণে বাবার চোখে চোখ রাখতেও সমস্যা হয়নি তার। কিন্তু তার নিপাট ভালো মানুষ সেজে থাকা বাবা জীবনে এই প্রথম তার গায়ে হাত তোলে। নাহ, হাত নয় আসলে পা তোলে। ঘটনাটা বিশ্বাস করতে লিজার বেশ সময় লেগেছে।

যেই বাবা মাকে কখনো উঁচু কণ্ঠে বকেনি সে গতকাল মাকে মেরেছিল। তখনো অবাক হয়েছিল সে। আর আজ যখন তার তলপেটে লাথি দিয়েছে তখন বিস্ময়ের পারদ এত উঁচুতে উঠেছিল যে, সে প্রথমে কোনো ব্যথাই অনুভব করতে পারেনি। পরে যখন নিজেকে ভেজা মাটিতে বসা আবিষ্কার করে, তখনই তলপেটে তীক্ষ্ণ সুচালো ব্যথাটা অনুভব করে সে। অনেক চেষ্টা করেও বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারে না। পরে এক প্রতিবেশী মহিলা তাকে দেখতে পায়। ধরাধরি করে নানির কাছে দিয়ে আসে।

এ ঘটনার একদিন পেরিয়ে গেছে। লিজা তার মা মোমেনাকে ফোন করে সবিস্তারে বলেছে সব। বাবা তার ভাইবোনদেরকে নিয়ে ছোট বউয়ের কাছে রেখেছে সেটাও বলতে ভুলেনি। মোমেনা সব শুনে বলল, ‘হারামীর পুতের এত সাহস হয় ক্যামনে! আমার মেয়েরে লাথি মারে! সব অই ফইন্নির বেটির কারণে। তুই চিন্তা করিস না। তোর মামাকে আমি ভালো করে বুঝায়ে বলসি। উনি কোনো না কোনো ব্যবস্থা নেবেন।’

‘আচ্ছা তুই এখন তুহিনের সাথে পালায়া যেতে পারবি?’
মায়ের এমন আচমকা উদ্ভট প্রশ্নে লিজা চমকে উঠে, ‘এসব কী বলো আম্মু? পালায় যাব কেন?’
মোমেনা ধমকে ওঠে, ‘বেশি কথা বলিস না। আমার কথা শোন, তুহিনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তোরা পালিয়ে যা। এখন না, কয়দিন পর। আমি বলব কখন যাবি!’
‘কিন্তু পালাব ক্যান সেটা তো বলবা।’ অধৈর্য হয়ে উঠে লিজা।
মোমেনা বলে, ‘তোর মামার বুদ্ধি এটা। তোর বাপ আজকাল কী হম্বিতম্বি শুরু করছে তুই দেখতছস না? আগে ব্যাটার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের করা যায়তো না। আর এখন আমার কাছে সবকিছুর হিসাব চায়, কোথায় কী খরচ করসি, কেন করসি, কই গেছি কেন গেছি সবকিছুর কৈফিয়ত চায়! একটু টাইট তো দেওয়া লাগবই!’

লিজার মাথায় এসব কিছুই ঢোকে না। বাবাকে টাইট দেয়ার জন্য তাকে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে কেন? তাও এখনই? সে এখনই বিয়ের কথা ভাবছে না। সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়ালেখা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এই সময় বিয়ে করলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে। তার পরিকল্পনায় তো এটা ছিল না। এমনিতে তুহিনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হচ্ছে তার। বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে খেলাটা বড় বেশি বোকামি হয়ে যাবে না তো?

‘কীরে কিছু বল?’ মোমেনা বেগম তাড়া দেয়।
লিজা সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে বলে, ‘আমি মামার বাসায় আসতেসি। ওইখানে কথা বলব।’


‘ভাবিসাব কই? একটু ডাক দেন। সালাম জানাই।’
পান খাওয়া কালচে লাল রঙের এবড়োথেবড়ো দাঁত বের করে হেসে কথাটা যিনি বলেছেন তিনি তাহের নূরী। কালো বর্ণের লোকটা কুতকুতে চোখে যখন তাকায় শৈলীর গা ঘিনঘিন করে ওঠে। মনে হয় তার সামনে একটা সাপ বসে আছে। কালো-ধলো এসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। তার ভাবনার বিষয় হচ্ছে মানুষের চরিত্র কেমন সেটা! এই যে তার বাবা মফিজুর রহমানের লাল-সাদা মিশেলে চমৎকার গায়ের রং, তাতে কী যায় আসে! চরিত্রতে যে দোষ আছে তা শরীরের রঙে কি চাপা পড়ে!

শৈলী তাহের নূরীর সামনে জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল বড় ওড়নায় মাথা ও শরীর ভালোভাবে ঢেকে রেখেছে সে। দেখে মনে হবে জ্বর-টরে ভুগছে অথবা শীত লাগছে তার। আসলে কোনোটাই নয়। তাহের নূরীর কুতকুতে চোখের অশ্লীল চাহনি থেকে বাঁচার জন্যই এই ব্যবস্থা।

মফিজ ত্যালত্যালে হাসি দিয়ে বললেন, ‘শৈল, তোমার আম্মুকে বলো তোমার আংকেল সালাম দিসে।’
পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে সালামের জবাব দিলেন আছিয়া খাতুন। তাহের নূরী কয়েকটা কথা বললেন। রান্নার প্রশংসা করলেন। সেই সাথে উঁকিঝুঁকি দিলেন। কিন্তু আছিয়া খাতুনের নখের ডগাটাও দেখতে পেলেন না।

মফিজও তাহের নূরীর অভিসন্ধি বুঝতে পারলেন। গলা টেনে বললেন, ‘শিহাবের মা, অসুবিধা নাই। সামনে আসতে পারবা।’
এতক্ষণ অনেক কষ্টে ধৈর্য ধরে রেখেছিল শৈলী। এরকম ঘটনা আগেও কয়েকবার হয়েছে। সব সময় শৈলী চুপ করে থাকত। এবার আর পারল না। ঝট করে বলেই ফেলল, ‘আব্বু, আপনি না আম্মুকে কারও সামনে না যেতে বলেন। আবার তাহের আংকেলের সামনে কেন আসবে?’

চোখ দুটো বড় বড় করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে মফিজ। অবস্থা বেগতিক দেখে তাহের নূরী নিজেই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন দ্রুত। মোমেনা পান নিয়ে সামনে এসে চেয়ার টেনে বসে। তিন জন মিলে তুখোড় আলোচনা হয়। আলোচনা শেষে রাত বারোটা নাগাদ প্রস্থান করেন তাহের নূরী।

মফিজের মেজাজ আজ সপ্তমে চড়ে আছে। শিহাব বাসায় এসে তাহের নূরীকে দেখেও সালাম করেনি। সোজা ভেতরে চলে গিয়েছিল। আর শৈলীর জবাবটা তো তার গালে চড় মারার মতোই ছিল। ছেলে-মেয়ে দুটোর এত সাহস হলো কী করে ভেবে পান না তিনি।

রাতে ঘুমানোর সময় শৈলী ঠাস ঠাস করে মারের শব্দ শুনতে পায়। সাথে মায়ের গোঙানির আওয়াজ। আর মফিজের তপ্ত বাক্য, ‘এগুলা আমার রক্ত-বীর্য না। কার সেটা তুই-ই ভালো জানোস। আমার হইলে কখনো আমার মেহমানকে অপমান করত না, আমার সাথে এরকম ব্যবহার করত না!’

শৈলীর মাথার বালিশ ভিজে যাচ্ছে চোখের পানিতে। সে এখন চাইলেও পারছে না ওই রুমে গিয়ে বাবাকে আটকাতে অথবা মাকে বাঁচাতে। এত রাতে বাবা-মায়ের বেডরুমে যাওয়ার মতো সাহস সে এখনো সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। এর জন্য স্রষ্টার ওপর তার ভীষণ অভিমান হচ্ছে তার।

আজ রাতে আর ঘুম হবে না শৈলীর। অথচ পাশে শুয়েই মোমেনা ভাবছে, ভাইয়ের বাসায় আসার পর আজকে রাতেই তার শান্তির ঘুম হবে। তাহের নূরীর সাথে কাল তার পরিচিত এক মহিলার সাথে দেখা করতে যাবে। নারী ও শিশু অধিকার সংস্থার সাথে জড়িত আছে সে। তার সাথে পরামর্শ করে বাদলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

ভাই-ভাবির রুম থেকে ভেসে আসা মারের শব্দ সেও শুনছে। সন্তুষ্টচিত্তে চোখ বুঝে নিলো সে। যেন কোনো সুমধুর গান বাজছে কানের পাশে!

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ সপ্তম পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ সপ্তম পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ ষষ্ঠ পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [সপ্তম পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [ সপ্তম পর্ব ]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: