এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন
এগারো টাকার সাথে আমার স্মৃতি, আমার গল্প বহু বহু পুরোনো!
স্কুল জীবন থেকেই ইদ সেলামি, বৃত্তির টাকা, বড়োদের দেওয়া গিফটের টাকা, টিফিন-গাড়ি ভাড়ার টাকা, ইত্যাদি সব না খেয়ে আব্বুর দেওয়া একটা পুরোনো মানিব্যাগে জমাতাম! কলেজে উঠা পর্যন্ত আমার কখনো টাকার অভাব হয়নি! কারণ আমার একমাত্র খরচের খাত ছিল ক্রিকেট খেলার জন্য জাম্বুপ্লেন টেনিস বল ও ওসাকা টেপ কেনা; এরপর বই কেনা পর্যন্ত! মাঝে ক্লাস নাইনে থাকার সময় সাইকেল কেনা আর আমার প্রথম ল্যাপটপ কেনার জন্য ১২-১৫ হাজার টাকার মতো বাসায় দিয়ে দিয়েছিলাম জমানো টাকা থেকে!
তো, জীবনে প্রথম টাকার আসল অর্থ বুঝতে শুরু করি, কলেজে ভর্তির পর! সিটি কলেজে ভর্তির পর, ৩-৪ মাস মামার মেসে ছিলাম, এরপর আমাদের বাসা নিয়েছিল শহরে! মেসে থাকার সময়টাতেই আমি টাকার মর্ম বুঝতে পারি! ১১ টাকার সাথে সম্পর্কও তখন থেকে শুরু! মাসের শেষ দিকে বাসা থেকে পাঠানো টাকার কিছুই হাতে থাকে না! ঘর থেকে দেওয়া ডিম আর আলু দিয়ে দুই বেলা ভাত খাই! কোচিং এ যাই হেঁটে হেঁটে, কলেজে যাই হেঁটে হেঁটে; জরুরি দরকারে কিংবা কোনো কম গুরত্বপূর্ণ কারণে পকেট কিংবা মানিব্যাগ হাতালে ১১ টাকা বের হয়!
আরও পড়ুন: আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা | আবুল হাসনাত বাঁধন
মোবাইলে রিচার্জ করার জন্য কিংবা কোনো একটা বাইরের খাবার খুব খেতে ইচ্ছে করছে; এমন টাইমে পকেট, মানিব্যাগ, কলেজ ব্যাগ সব ঘেঁটে ঘুঁটে খুঁজলে ১১ টাকা বের হয়! মেসে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার হয়েছে এটা! এরপর আমাদের বাসা নেওয়ার পর, নিজের ব্যক্তিগতভাবে আর টাকার প্রয়োজন পড়েনি খুব একটা!
এরপর কলেজ পাস করলাম! প্রথম বার কোনো ভার্সিটিতে চান্স হলো না! ২০১৭ সালে কোনো ভিত্তি ছাড়াই, হাওয়ার ওপর বাসা ছেড়ে চলে গেলাম! ২০১৭ এর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঢাকাতেই ছিলাম! এর মধ্যে জান্নাতকে নিয়ে মে মাসে বাসা নেওয়ার আগ পর্যন্ত ভার্সিটির হলে, এর – ওর মেসে, বাসায়, কখনো রাস্তায় – ফুটপাতে কাটিয়ে দিয়েছি! বাসা থেকে অনেক টাকা পাঠিয়েছিল কিন্তু পর্যাপ্ত না! ওই সময় ঢাকার অনেক ভাই বোন- টাকা দিয়ে, থাকতে দিয়ে, নানাভাবে আমাকে সাহায্য করেছে! বিশেষ করে মাহমুদ ভাইকে আমি কখনো ভুলব না! ওই সময় উনি সাহায্য না করলে, আমি এই জীবনে ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারতাম না! আজ যত কিছু করছি, তার কিছুই হয়তো করা হতো না! যখনই কোনো সমস্যায় পড়তাম ভাই হেল্প করতেন!
তো, ওই সময়টাতেও ১১ টাকার কাহিনি অনেকবার ঘটেছে! ফেসবুক পোস্টের সুবাদে এক বারের কাহিনি বেশ স্পষ্টই মনে আছে! ১৭ এর বইমেলা চলছে! মেলায় আমাদের ২টা বই বের হয়েছে! তো, সারাদিন মেলায় কাটানোর পর সেদিন রাতে আমার থাকার জন্য কোনো জায়গা নেই! পরে অনেক কষ্টে মাহমুদ ভাই ব্যবস্থা করলেন! সেদিন রাতে আমি উনার এক ছোটো ভাইয়ের মেসে থাকলাম! পরদিন বইমেলাতে আসলাম! মেলায় সারাদিন থাকার পর, সন্ধ্যায় ওই ভাইয়ের মেসে যাব, এমন সময় উনার কল আসলো! উনি জানালেন, উনি জরুরি কাজে দিয়াবাড়ি চলে গেছেন, আজ আর আসবেন না। উনার রুমে উনার ফ্রেন্ড থাকবেন, আমি আজকে থাকতে পারব না! এরপর মাহমুদ ভাই অনেক ট্রাই করলেন, কাউকে পাওয়া গেল না! কারও বাসা বা মেসে থাকার ব্যবস্থাও হলো না! শেষ একটা উপায় ছিল জান্নাতের পরিচিত কারও কাছে থাকা, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ থাকায় সেদিন ওর সাথে আমি আর যোগাযোগই করতে পারিনি! সেই রাতটা আমাকে শাহাবাগ মোড়ে বসে বসে কাটিয়ে দিতে হয়েছিল!
আরও পড়ুন: আমরা তিনজন | বুদ্ধদেব বসু
অবশ্য সময়টা ভালোই কেটেছিল! বিইউপিতে বিবিএ পড়া এক বাউণ্ডুলে ভাইকে পেয়েছি, উনি একতারা নিয়ে সারারাত ঢাকার রাস্তায় ঘুরেন! আর মোড়ে বসে চা – সিগারেট খেয়ে খেয়ে গান করেন! সাথে একজন বন্ধু / ভক্ত ছিল উনার! উনারা আমার সাথে বেশ অনেক্ষণ আড্ডা দিয়েছেন; গান শুনিয়েছেন! প্রায় রাত ৪ টা পর্যন্ত শাহাবাগে ছিলেন উনারা! এরপর বাড়ি চলে যান! মাঝে একবার শাহাবাগ থানার পুলিশ আমাদের চেক দিয়ে যায়, ওই ভাই তার আইডি কার্ড দেখায়, আর আমি বলি- আমাদের বই পাব্লিশ হয়েছে, মেলায় এসেছি বইয়ের কাজে, ঢাকায় থাকার মতো কেউ নেই! সেই সাথে আমাদের বই দুইটা দেখাই! এরপর পুলিশরা আর কিছু বলেনি, চলে যায়!
ওই ভাইয়েরা যাওয়ার পর শাহাবাগ মোড়ের পরোটা বিক্রেতার সাথে গল্প করতে থাকি, তার জীবনের কাহিনি শুনতে থাকি! তার সাথে গল্প করতে করতে সকাল হয়ে যায়! সকালে আটটা নয়টার দিকে ওই ভাইয়ের মেসে যাই, আমার কিছু জিনিস ছিল ওগুলো আনতে! উনার বিছানায় উনার ফ্রেন্ড থাকায় ফ্লোরে শুয়ে, মাথার নিছে কয়েকটা গল্পের বই দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিই! ঘুম ভাঙার পর দেখি খিদেয় পেট চুঁ চুঁ করছে! মনে পড়ে, গতকাল দুপুর থেকে, রাতে ওই ভাইদের খাওয়ানো চা আর একটা পরোটা ছাড়া কিছুই খাওয়া হয়নি আমার! এই মেসে খাওয়ার-দাওয়ারও ইয়াত্তা নেই, আমি যার কাছে এসেছি সেও নেই মেসে! তাই বাইরে থেকে কিছু খাওয়ার জন্য ব্যাগ আর মানি ব্যাগ চেক করি! অদ্ভুত কিংবা পৃথিবী অষ্টমাশ্চর্যের মতো আবিষ্কার করি, আমার মানিব্যাগে ঠিক এগারো টাকা-ই আছে! এই এগারো টাকা নিয়ে আমার ফেসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্টটা এখনো আছে!
এরপর, বহুবার এই এগারোটা টাকা আমার জীবনে ফিরে এসেছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন ভাবে!
খুব সাম্প্রতিক একটা ঘটনা হলো, হাতে টাকা পয়সা একেবারে নেই! কয়েকজনের কাছে কাজের টাকা পাই, সেগুলো দেয়নি! আবার কয়েকজন আমার কাছেও টাকা পায়! টাকা নিয়ে খুব ঝামেলা যাচ্ছে, এর মধ্যে একদিন সকালে খুব খিদে পেয়েছে! ভাবলাম দোকান থেকে কয়টা পরোটা এনে খাব! ভেবেছি মানিব্যাগে অন্তত ২০-৩০ টাকা থাকবে! কিন্তু মানিব্যাগ নিয়ে দেখি, সেই এগারো টাকাই আছে ব্যাগে! অবাক হলাম না!
আরও পড়ুন: অগল্প আগল্প ইগল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন
এরপর এগারো টাকা নিয়েই দোকানে গেলাম পরোটা কিনতে! ৫ টাকা করে ২ টা পরোটা পাওয়ার কথা! পরোটা নিয়ে এগারো টাকা দিয়ে এক টাকার জন্য অপেক্ষা করছি; এদিকে দোকানদার বলে- আরও এক টাকা দেন, পরোটা ৬ টাকা কইরা! পড়ে গেলাম ভীষণ লজ্জায়! পরিচিত দোকান হওয়ায় কোনোভাবে নিজেকে সামলে বললাম, এক টাকা ভাংতি নাই, পরের দিন নিয়েন! দোকানদার ‘আচ্ছা’ বললেন! আমি ভীষণ অপ্রস্তুত অবস্থা নিয়ে বাসায় ফিরলাম!
এই এগার টাকার দেজা ভ্যু একদিন হয়তো আমার পিছু ছাড়বে! একদিন মানিব্যাগ হাতড়ালে হয়তো হাজার টাকা বের হয়ে আসবে! তবু আমি এই এগারো টাকার দিনগুলোকে কখনো ভুলতে পারব না! এগুলো আমার থ্যালামাসের ভেতর জ্যান্ত স্মৃতির সরীসৃপ! এরা হেঁটে হেঁটে আমায় জীবনকে পড়তে – বুঝতে শেখায়। আমাকে বেঁচে থাকার, এগিয়ে যাওয়ায় শক্তি জোগায়! এগারো টাকার গল্পগুলো না থাকলে আমি কবেই ফুরিয়ে যেতাম; এগারোর পাশে কয়েকটা শূন্য লাগানোর চেষ্টায় দিন-রাত এক করে তীব্র স্পৃহা নিয়ে টিকে থাকার লড়াইটা হয়তো চালিয়ে যেতে পারতাম না!
এগারো টাকার জীবন | © আবুল হাসনাত বাঁধন
(১৫/০৬/২০২১)
পটিয়া, চট্টগ্রাম।
[ট্যাগস:
এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন,
এগারো টাকার জীবন – আবুল হাসনাত বাঁধন,
এগারো টাকার জীবন,
আবুল হাসনাত বাঁধনের লেখা এগারো টাকার জীবন,
মুক্তকথা, মুক্তগদ্য, নন-ফিকশন]