অবিচার [ তৃতীয় পর্ব ]

অবিচার [তৃতীয় পর্ব]

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:

শৈলীর মন একটু বেশিই খারাপ। বাসায় মোমেনা ফুফু এসেছে। উনি আসা মানেই ঝামেলার পাহাড় নিয়ে আসা। আর তিনি যতদিন থাকবেন সেই পাহাড় তাদের মাথার ওপর একটু একটু করে ভাঙতে থাকবে।

ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে, ফুফু খুব আহ্লাদ করে তাদের সাথে। যেন ভাবী আর ভাইয়ের বাচ্চাদের অনেক বেশি ভালোবাসে। কিন্তু বাস্তবতা অন্য রকম। মোমেনা বেগমের মনে প্রাণে বিশ্বাস, এরা তার চেয়েও বেশি সুখে আছে। আর এদের সুখটাই তার সহ্য হয় না। এই জন্য নানা রকম ঝামেলা পাকান। এবার কোন ঝামেলা পাকাতে এসেছেন কে জানে!

দুপুর বেলার প্রখর রোদে ছাদে দাঁড়িয়ে সাত-পাঁচ ভাবছে সে। তার পরীক্ষা চলছে এখন। এইচএসসি প্রথম বর্ষের ফাইনাল দিচ্ছে সে। এরই মধ্যে ফুফু এসে হাজির। পরীক্ষাটা শেষ হয়ে যেত! তার অঘটনঘটনপটিয়শী ফুফু এর আগে কত শত বিপত্তি ঘটিয়েছেন সেগুলো মনে করতেই শৈলীর বুকের পানি শুকিয়ে আসে।

এইতো কয়েকমাস আগে যখন এসেছিল, দিন সাতেক থেকে গেছে। যাওয়ার আগের দিন ইনিয়ে বিনিয়ে তার মাকে বলেছিলেন, ‘ও ভাবি, এতদিন থাকলাম শুধু শাক, ডাল, ভর্তা-ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়াইসো। একটু মাছ-মাংস রানতে পারতা না? আবার কখন আসতে পারি কোনো ঠিক নাই।’

আছিয়া খাতুন পড়েছিলেন মহাবিপাকে। মাছ-মাংস তাদের বাসায় মাসের মাঝামাঝিতে একবার খাওয়া হয়। এখন মাসের শেষের দিকে। মাছ-মাংস খেলে বাকিদিন ডাল-ভাতও জুটবে না। এই সহজ কথাটা মোমেনা বেগমকে বুঝিয়ে বলার সাহস হয় না তার। আদরের ভগিনী যদি তার গুণধর ভাইকে প্যাঁচ লাগিয়ে বসে!

কী করবেন না করবেন এই দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ। তখন শৈলী জানতে চায়, ‘কী আম্মু, এত কী চিন্তা করো?’ তিনি বিরস মুখে জবাব দিলেন, ‘তোর ফুফু তো মাছ-মাংস খাইতে চায়। কী করি বল তো?” কথাটা শুনেই শৈলী চট করে রেগে যায়, ‘নিজের ভাইরে চেনে না? এত আহ্লাদ করে ক্যান? আর তুমিও এমন ক্যান আম্মু? আসল কথাটা বলে দিলেই তো পারো। খামোখা নিজের মাথায় টেনশন নাও!’

আছিয়া খাতুন মেয়ের ঝাড়ি খেয়ে চুপসে যান। এ যুগের মেয়ে, চঞ্চল বেশি। কিছু বুঝতে চায় না। আছিয়া খাতুন শেষমেষ মফিজকেই বলেন। সাথে সাথেই জবাব আসে, ‘খাইতে চাইলে খাওয়াও।’

ব্যস এটুকুই। আছিয়া খাতুনের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়েছে। ভাই-বোন দুজন মিলে তাকে এ কোন সমস্যায় ফেলল! মোমেনার চাহিদা পূরণ করা এখন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ভেবে শেষ ভরসা হিসেবে একটা সহজ পন্থা পাওয়া গেল।

পাশের বাসার কর্তা মাছ ধরার ট্রলারে কাজ করে। সপ্তাহান্তে সাগরের বড় বড় মাছ আসে তাদের বাসায়। তিনহাত দূরে থেকেও সব সময় মাছের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায়। সেই বাসার মহিলা অনেকবার আছিয়া খাতুনকে মাছ কেনার জন্য সেঁধেছে। এত বড় মাছ বাজারে হাজার বারো’শর নিচে পাওয়া যাবে না। আছিয়া খাতুনের জন্য অর্ধেকে ছেড়ে দিতে রাজি আছে সে। কিন্তু আছিয়া খাতুন সেই বিশালাকার মাছের দিকে শুধু জুলুজুলু নয়নে তাকিয়ে থাকতেন। কখনো কেনার সাহস করেননি। এখন এই পরিস্থিতিতে তার কাছেই বুঝি ধর্না দিতে হবে।

সেবার সাড়ে তিনশ টাকা দিয়ে মধ্যম মানের একটা লাক্ষ্যা মাছ কিনেছিলেন আছিয়া খাতুন। কয়দিন পরেই মাস ফুরাবে। তখন বেতন পেলেই টাকা দিয়ে দেবে এই শর্তে মাছটা কেনা হয়েছিল।

কিন্তু খাওয়ার সময় সেটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেছে। মফিজ তো পারলে ভাত-তরকারির প্লেট উল্টে দেন। ‘চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে লইট্টা মাছ কিনতে পারতি না? তোরে কে বলসে এত দাম দিয়া মাছ কিনতে? এর এক টাকাও আমি দিমু না, বলে দিলাম!’

সেই মাছই তৃপ্তি সহকারে মফিজ তিন-চার টুকরো খেয়ে ফেলেছিলেন। মোমেনা বেগম আবদারের সুরে বলেছিলেন, স্বামী আর বাচ্চাদের নিয়ে আসলে তারা কি খেত না? তাদের ভাগেরগুলো যেন একটা বক্সে দিয়ে দেয়। যাবার সময় নিয়ে যাবে। বড়মুখ করে বলতে পারবে ভাইয়ের বাসা থেকে মাছের তরকারি দিয়েছে।

আছিয়া খাতুন চেয়েছিলেন ছেলে-মেয়ের জন্য দুই টুকরো রেখে দিতে। শৈলী আরেকটা ঝাড়ি দিয়ে বলেছিল, ‘এই মাছ খাওয়ার রুচি নেই আর। সব দিয়ে দাও।’

এমন আরও কত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে মোমেনা বেগমের দ্বারা তার কোনো হিসেব নেই। আজকে তার নাটকীয় এন্ট্রি দেখেই শৈলী বুঝে গেছে বেশ বড়োসড়ো সমস্যাই পাকাতে যাচ্ছে তার ফুফু।

এমনিতেই তাদের দুর্দশার অন্ত নেই। মফিজ যতক্ষণ বাসায় থাকেন ততক্ষণ দম বন্ধ হয়ে থাকে সবার। তিনি অফিসের জন্য বের হলেই নিশ্বাস ফেলে সবাই। যতক্ষণ মফিজ বাসার বাইরে ততক্ষণ তারা হাসিখুশি থাকে। সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে তাদের মুখেও অন্ধকার নেমে আসে। দম আটকে থাকে তাদের পরদিন তিনি অফিস যাবার আগ পর্যন্ত।

ছাদ থেকে শৈলী দেখতে পায় মফিজ বেরিয়ে গেছেন। এটাই বোধহয় একমাত্র চাকরি যেখানে দুপুর একটাই পৌঁছালে কেউ কিছু বলে না। মফিজ একটা ছোটোখাটো মসজিদের ছোটোখাটো ইমাম। ফজরের নামাজের দায়িত্ব অন্য একজনকে দিয়েছেন। কারণ মফিজ বাসাপ্রিয়।

নাহ, সে আসলে টিভিপ্রিয়। এশার নামাজ পড়িয়ে বাসায় চলে যান। রাত তিনটে পর্যন্ত টিভি দেখেন। সকাল নয়টা-দশটায় ঘুম ভাঙে তার। ফজরের নামাজ শেষ কবে পড়েছেন সেটা মফিজের নিজেরও মনে নেই। অথচ সবাইকে বলে বেড়ান বউ-বাচ্চার সাথে না থাকলে তার ভালো লাগে না। তাই রাতটা বাসায় কাটান তিনি। বাইরের মানুষের কাছে এটা একটা সুখী পরিবার।

মফিজকে বেরিয়ে যেতে দেখেই শৈলী দ্রুত নিচে নেমে যায়। অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এখন পড়তে বসা জরুরি। বাসায় ঢুকতেই সে মোমেনা বেগমের আহাজারি শুনতে পায়, ‘ক্যামন জালিমের ঘরের জালিম! আমার গায়ে হাত তুলে! কত্তবড় কলিজা তার! ভাইজান যদি এর বিচার না করে তাইলে আমি আর যাব না। শুইনা রাখো ভাবী, অই জালিমের সংসার আর করব না আমি।’

শৈলী বুঝতে পেরেছে তার অতি ভদ্র ফুফা তার ফুফুকে মেরেছে। কিন্তু সে তাজ্জব বনে যায় এই ভেবে, কার কাছে বিচার চাইতে এসেছে ফুফু? যে লোকটা নিজের বউ-বাচ্চাকে এখনো গরু-পেটা পেটায়, সে করবে অন্যের বিচার! তাও বউ এর গায়ে হাত তুলেছে বলে! সে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারে না। বইয়ের পাতায় চোখ ও মন নিবদ্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে সে।

(চলবে)


[কীওয়ার্ডস:

অবিচার [ তৃতীয় পর্ব ] | সালসাবিলা নকি

অবিচার [ তৃতীয় পর্ব ] : সালসাবিলা নকি

অবিচার [ তৃতীয় পর্ব ] – সালসাবিলা নকি

ছোটোগল্প | অবিচার [তৃতীয় পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [তৃতীয় পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প : অবিচার [তৃতীয় পর্ব]

সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প – অবিচার [তৃতীয় পর্ব]

ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: