স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প

স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প

স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

এক.

আজ জাহানারার জন্মদিন ছিল। অজানা কারণে অথবা দৈবভাবে প্রতিবছর ওর জন্মদিনে বৃষ্টি নামে। আজও ব্যতিক্রম ঘটেনি! বরং আকাশ কালো হয়ে ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল! দুজন কাকভেজা হয়ে যখন টিএসসি পৌঁছেছি, তখন বৃষ্টির তাণ্ডব অনেকটাই কমে গেছে! প্রতিবছর এই দিনে জাহানারা সুমাইয়ার সাথে দেখা করে, ওকে চুমু খায়, নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। সাথে আরও কয়েকজনকে। এই হলো তার জন্মদিন উদযাপন। সুমাইয়ার বয়স চার বছর। টিএসসিতে যে একদল শিশু ফুলবিক্রেতা দেখা যায়, তাদের দলনেত্রী সে। তার আরও একটা পরিচয় আছে, সেটা হলো আমার আর জাহানারার কুড়িয়ে পাওয়া আত্মিক বা আত্মা-সম্বন্ধীয় বোন। প্রতিবার আমাদের দেখলে, সে রফিক ভাইয়া-জাহানাপু বলে ঝাপটে পড়ে! জাহানারার এবারের জন্মদিন প্রতিবারের মতো ঝড়-বৃষ্টি, সুমাইয়া, সুমাইয়ার উপহার দেওয়া ফুল দিয়েই শেষ হতে পারত! কিন্তু হয়নি। ব্যতিক্রম যা ঘটেছিল, তা হলো— এই বছর আমিও জাহানারাকে উপহার দিয়েছি, একটা কবিতার বই আর দুটো পূর্ণ বাক্য!

আজাদ স্যারের ‘কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু’ হাতে দিয়ে বলেছি— ‘আমি তোকে পছন্দ করি (ভালোবাসি শব্দটা আড়ষ্টতা কাটিয়ে বের হতে পারেনি।) আজ থেকে আমরা তুমি করে বলব, তুই-তোকারি আর চলবে না।’ জাহানারা বত্রিশটা দাঁত দেখিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘শালা বলদ, এটা একটা প্রোপোজিং স্টাইল হলো!’ আমি চুপচাপ গর্দভের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর কোনো কথা না বলে দুজনে সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম। শাহাবাগ থেকে ৮ নাম্বার বাসে উঠলাম, শ্যামলী নামলাম, ওকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। এই পুরো পথ জুড়ে দুজন আর একটা কথাও বলিনি! নিজের মেসে ফিরে বসে বসে পুরো বিষয়টা ভাবছিলাম! না, এই মেয়ে আমাকে গুরুত্বই দেয় না, ওর সাথে প্রেম দূরে থাক, বন্ধুত্বটাই রাখা উচিত না। কিন্তু ও ছাড়া আমার আছেই বা কে? কেউ তো নেই। না কোনো বন্ধু-বান্ধব, না কোনো স্বজন! পৃথিবীতে একমাত্র জাহুই (জাহানারাকে আমি সংক্ষেপে জাহু ডাকতাম) তো আমার খোঁজ নেয়, খোঁজ রাখে! এসব কথার জাল আমার মস্তিষ্কে বিস্তার হওয়ার আগেই আমার ফোনে টুং শব্দ করে একটা মেসেজ আসলো! জাহু নামের কন্টাক্ট নাম্বার থেকে পাঠানো! লিখেছে, ‘এই যে মিস্টার রফু, ওরফে হাবামন্ত্রী গোবাচন্দ্র, আপনার উপহার ও প্রস্তাব আমি গ্রহণ করলাম! আজ থেকে তাহলে তুমি আমার আপনি-তুমি-তুই স্থানে আজীবনের জন্য স্থাপিত হলেন!’ মেসেজটা বুঝলেও আপনি-তুমি-তুই বিষয়টা পুরোই মাথার ওপর দিয়ে গেছে! সেই থেকে বিষয়টা মাথার ভেতর ঘুরছে তো ঘুরছেই, হিসেব-ই মেলে না! এদিকে আবার দেখি, ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে, ঠাডা সমেত।

দুই.

আমি আর জাহু বিশ্ববিদ্যালয়ে জিন প্রকৌশলে পড়ি। স্কুল কলেজে ভালো ছাত্র/ছাত্রী, মেধাবী ট্যাগ থাকলেও, ভার্সিটিতে আমাদের সিজিপিএর ওপর স্রষ্টার কৃপা দৃষ্টি পড়ে না! তাই সিজিপিএর গড় সংখ্যাটা সব সময় দুইয়ের একটু বেশি ও আড়াইয়ের চেয়ে কমই থাকে! এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আশরাফ মামা থেকে শুরু করে ডিন স্যার পর্যন্ত; সব স্যার-ম্যাম, ছাত্র-ছাত্রী আর কর্মচারী সবাই আমার আর জাহুর খবর জানেন! মাঝে মাঝে আশরাফ মামা আমাকে টিপ্পনী কাটেন এটা ওটা বলে। এভাবেই পার হতে পারত আমাদের ভার্সিটি লাইফ! কিন্তু হয়নি! মাঝপথে বাগড়া বাঁধাল হ্যাংলা, ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে। মৌরী। মৌরী আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইমিডিয়েট জুনিয়র! ওদের ব্যাচ যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হলো আমরা ওদেরকে অভ্যর্থনা দেওয়ার নামে র‍্যাগ দিতে ডাকলাম একদিন। এটা এই ক্যাম্পাসের অনেক প্রাচীন প্রথা। সিনিয়র হিসেবে নবাগতদের আপ্যায়ন করতে হয়, ম্যানার শেখাতে হয়। তো, র‍্যাগিংয়ের সময় আমরা জুনিয়রদের একজন একজন করে ডাকছিলাম, আর ওরা একজন একজন করে এসে আমাদের কাছে নিজের পরিচয়, স্কুল-কলেজ, গফ-বফ ইত্যাদি ইতিবৃত্তান্ত দিচ্ছিল। আর ম্যানার ভুল করার নামে সবাইকে শাস্তিও পেতে হচ্ছিল! শাস্তিগুলো আবার অনেক মজার! এই যেমন: নাচা, গান করা, আবৃত্তি করা, প্রোপোজ করে দেখানো ইত্যাদি। এর মধ্যেই হঠাৎ মৌরী আসলো! আমি ওকে দেখে হাঁ হয়ে গেলাম। অবিকল সেই চোখ, সেই মুখ! তফাত শুধু মৌরী বেশ চিকনা, ছিপছিপে শরীর! আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না! এ কেমনে সম্ভব! ও আমাদের সামনে এসে ইতস্তত করে নাম বলল, মৌরী উষসী! নামটাও অদ্ভুত! আমার ওর জন্য মায়া হলো। ওকে চলে যেতে বললাম! কেন জানি ওকে র‍্যাগ দিতে মন সায় দেয়নি।

আরও পড়ুন: আত্মার নিরুদ্দেশ যাত্রা | আবুল হাসনাত বাঁধন

সেদিনের পর থেকে আমার আর জাহুর মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হতে শুরু করল। দেয়ালের প্রতিটা পরত মৌরীর চোখ মুখ দিয়ে আঁকা। অবশ্য মৌরীর সাথে শুরুতে বেশ ভালোই সম্পর্ক হয়েছিল জাহুর! বোন-বোন সম্পর্ক। সুমাইয়ার মতো জাহু মৌরীকেও বুকে পুষছিল। মাঝপথে গলার কাঁটা হয়েছি আমি, আমার চোখ। ক্যাম্পাসে গেলেই মৌরীকে দেখে আমি বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। এক ঝাঁক বিষাদের ঘুণপোকা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। যে দুর্বিষহ অতীত থেকে আমি পালিয়ে এসেছি, সেটাই আবার আমার মস্তিষ্কে ঝেঁকে বসেছে! সেই অবিকল চোখ, নাক, মুখ আমার থ্যালামাসে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। ক্যাম্পাসে অধিকাংশ সময়েই আমি চাতক পাখির মতো মৌরীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে ওর সাথে চোখাচোখি হলে বিব্রত হই।

তারপর যা হওয়ার ছিল, তাই হলো। আমার আর জাহুর বিচ্ছেদ পরিণিতি। আমি হতবম্ব নিশ্চুপ ছিলাম, ওকে শেষবারের মতো বলতে পারিনি, ‘তুমি যা ভাবছো, আসলে সেটা সত্য না! আমার সমস্ত ভালোবাসার অনুভূতি তো শুধু তোমার জন্যই। মৌরীর বিষয়টা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু!’ জাহু চোখে জল নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘তোমার কাছে এটা আশা করিনি! শেষে কিনা পিচ্চি একটা মেয়ের প্রতি, তাও আবার আমাদের জুনিয়র, আমার ক্লোজ বোন। ছিঃ!’ আমি ওর পায়ের সাথে মিলিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকি! আস্তে আস্তে বিকেলের সূর্যটাও মিলিয়ে যায় পশ্চিম আকাশে।

এরপর থেকে শুরু হলো আমার একাকিত্বের দিনগুলো। আমি ঠিকমতো খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না! এক ঝাঁক বিষাদ গলার কাছে এসে দলা পাকায়। আমি নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিই সেগুলো। রোজ সকালে ধানমণ্ডি লেকে হাঁটতে যাই। পলকহীন বিষণ্ণ চোখ দিয়ে লেকের স্থির জলে জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে থাকি। অতীত পোকা আমার মাথাটাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব আমি অনেক ভাগ্য জোরে জাহুকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমার বেঁচে থাকার ভিত্তি হিসেবে। অথচ সেও টিকল না আমার জীবনে। সবাই খুব তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় আমার থেকে। আমারও কি প্রস্থান করা উচিত? পৃথিবীর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অনেক দূরে, ওপাশে চলে যাওয়া উচিত?

তিন.

আজ জাহুর জন্মদিন। আজকেও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি শুধু একবার জাহুকে দেখব বলে ভার্সিটিতে গেলাম পাক্কা তিন মাস পর। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হলো না, জাহু নাকি আজ ভার্সিটিতেই আসেনি। হতাশ হয়ে বের হয়ে গেলাম ভার্সিটি থেকে। ও হয়তো টিএসসিতে আছে, সুমাইয়াদের কাছে। ক্ষীণ আশা নিয়ে উঠে পড়লাম বাসে। আধা ঘণ্টা পর বাস আমাকে শাহাবাগ নামিয়ে দিলো। টিএসসি গিয়ে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম তা-ই। জাহু সুমাইয়াদের সাথেই। কী সুন্দর লাগছে ওকে! একটা সবুজ রঙের শাড়িতে লাল পাড়, কপালে নীল টিপ, ঠিক যেন স্বর্গের অপ্সরী! সবার ভিড়ে হঠাৎ ভেসে ওঠল মৌরীর মুখটা। মৌরীও আছে তাহলে জাহুর সাথে। আমার কি ওদের কাছে যাওয়া উচিত? না, ওর সুন্দর জন্মদিনটা মাটি করা উচিত না! আমি থেমে গেলাম।

আরও পড়ুন: আমরা তিনজন | বুদ্ধদেব বসু

মনের ভেতর অদ্ভুত দ্বিধা নিয়ে মাঝপথে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত সত্তা। ভেতরটা হাঁসফাঁস করছে। হীনম্মন্যতা বলছে পিছিয়ে যেতে, আবার জাহুর প্রতি জমিয়ে রাখা আবেগ বলছে সামনে এগিয়ে যেতে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি, এগোই না, পিছিয়েও যাই না। চুপচাপ জাহুকে আর মৌরীকে দেখতে থাকি! পৃথিবীতে কিছু মানুষকে দূর থেকে দেখার মধ্যেও অদ্ভুত মানসিক সুখ আছে! আমি সেই আশ্চর্য সুখ অনুভব করি অনেক্ষণ ধরে। ঠিক কতক্ষণ হিসেব করতে পারব না, তবে জাহুর জন্মদিনের টিএসসি পর্ব শেষ হয়, জাহু আর মৌরী পা বাড়ায় ফেরার পথে। ওই সময় আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। মগ্নচৈতন্য জেগে ওঠে আমার ভেতর থেকে। না, আজ সব কিছুর খোলাসা করতে হবে। আমি জাহুর সাথে শেষ একবার কথা বলব! এই চিন্তা নিয়ে আমি ওদের দিকে এগিয়ে যাই।

জাহু আমাকে দেখে কিছুটা ইতস্তত হয়। মৌরী বলে উঠে, ‘দাদা, তুমি এতদিন পর? কই ছিলে এতদিন?’

আমি ওর প্রশ্নকে গ্রাহ্য না করে বলি, ‘তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমাকে প্লিজ কিছুক্ষণ সময় দাও!’

মৌরী অবাক হয়ে বলে, ‘আমাদের সাথে? কী কথা দাদা?’

জাহু কেমন যেন অভিমানের সুরে বলে, ‘আমার সময় নেই রফিক! আমি তোমার কথা শুনতেও চাই না!’

আমি অনুনয় করে বলি, ‘প্লিজ জাহু! শেষ বারের মতো, জাস্ট ২০-৩০ মিনিট!’

আমার চেহারা দেখে হয়তো জাহুর মন কিছুটা গলে। সে রাজি হয়! আমরা তিন জন ঠং দোকানের টুলে বসি। সবার হাতে এক কাপ করে দুধ চা। আমি এক হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে, গ্যালারির একটা হিডেন ফোল্ডারে ঢুকি। একটা ছবি ওপেন করে ওরা দুজনের সামনে ধরি!

মৌরী যারপরনাই অবাক হয়ে, বিস্ফোরিত চোখে বলে, ‘আরে, আমার ছবি আপনার ফোনে কেমনে দাদা? কিন্তু আমি তো এত স্বাস্থ্যবান নই!’

জাহু একটু বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এসব দেখাতে এখানে বসেছো? এখন কি মানুষের, মানে মেয়েদের ছবি মোবাইলে নিয়ে নিয়ে ঘুরো?’

আমি দুজনের কোনো কথার উত্তর না দিয়ে, আরেকটা ছবি দেখায়। ওই ছবিতে মোট চার জন, দুজন ছেলে মেয়ে আর দুজন বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা। এই ছবি দেখে, জাহু আর মৌরী দুজনেই যথেষ্ট অবাক হয়ে যায়! ছবির ছেলেটা আমি। আর মেয়েটা হলো এর আগে যার ছবি দেখিয়েছিলাম। ওরা দুজন এক সাথেই জিজ্ঞেস করে উঠে, ‘কাদের ছবি? কারা এরা?’

আমি উদাস ভঙ্গিতে বলি, ‘এটা আমার ফ্যামিলি ফটো। আমি, আমার বড়ো আপু, আর আমাদের বাবা-মা!’

ওরা দুজন আরও হতবম্ব হয়ে যায়। দুজনের চোখে মুখেই প্রশ্ন, ছবির মেয়েটা, মানে আমার আপু দেখতে মৌরীর মতো কেন! ওরা কিছু বলার আগেই আমি নিজে থেকে বলি, ‘তোমরা হয়তো অবাক হচ্ছো, আমার আপু মৌরীর মতো দেখতে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমারও জানা নেই! আর আমিও অবাক হয়েছিলাম, প্রথম যেদিন মৌরীকে দেখেছিলাম! সেই চোখ, সেই নাক, সেই মুখ, সবকিছু হুবুহু মিল! পার্থক্য শুধু এই, আপু মোটামুটি স্বাস্থ্যবান ছিল, আর মৌরী চিকনা!’

জাহু এবার বলল, ‘তোমার পরিবারের কথা আগে কখনো বলোনি যে। আমি তো জানতামই না তোমার ফ্যামিলি আছে!’

আমি নিস্পৃহভাবে বললাম, ‘ফ্যামিলি? নেই! আগে ছিল! এখন আমার কেউই নেই! আমি মৌরীর চেহারার মাঝে আমার গঙ্গাফড়িংকে খুঁজে পেতাম, তাই ভার্সিটিতে সব সময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম!’

জাহু আবার বলে, ‘নেই মানে? বুঝলাম না কিছু! আর গঙ্গাফড়িং কে?’

আমি এবার স্মৃতির জাদুঘর থেকে আমার সমস্ত অতীত তুলে এনে ওদের দুজনকে বলতে শুরু করলাম!

চার.

‘বড়াপুকে আমি ভালোবেসে গঙ্গাফড়িং ডাকতাম! ওর আসল নাম রুকাইয়া। আপুও আমাকে ভালোবেসে প্যাঁচা ডাকত! ভালোবাসা আর খুঁনসুটি সমেত মা-বাবার সাথে বেশ ভালোই ছিলাম আমরা ভাই-বোন! আমার গঙ্গাফড়িং অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ছিল, আমাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। আমার মনে হয়, যাদের ঘরে বড়ো বোন আছে, বোনগুলো সবাই হয়তো ওর মতো লক্ষ্মী অথবা স্বরস্বতী দেবী! আর স্রষ্টা মনে হয়, বড়াপুকে বানানোর সময়, মেধা, সৌন্দর্য, মানবিকতা, স্নেহ, ভালোবাসা, ইত্যাদি সব গুণ দুহাত ভরে ঢেলে দিয়েছিলেন!

আরও পড়ুন: অচেনা বাঁকে | ফাহমিদা বারী

আমাদের সুখী পরিবারটা এরকম হাসিখুশিতে, ভালোবাসার ছায়ায় থাকত পারত। কিন্তু সেটা আর হলো না! আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে, নিজের মেধায় বড়াপু একটা পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল! ভার্সিটিটা আমাদের পাশের জেলায়! বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে। গাড়ি জার্নি করে ক্লাস করার ঝামেলাতে না গিয়ে, হলে উঠে পড়েছিল আপু। পুরো সপ্তাহে ক্লাস করত, আর বৃহঃস্পতিবার ভার্সিটির বাসে করে চলে আসতো বাড়িতে। আবার শনিবারে চলে যেত। বড়াপু ছয় দিন আমার থেকে দূরে থাকে, আমার এ নিয়ে মন খারাপ হতো খুব! আপুরও হতো সম্ভবত। তবে সে তার প্রিয় ভার্সিটি, প্রিয় বিষয়, হল, বন্ধু-বান্ধব এসব নিয়ে আবার খুশিও থাকত! আপুর শুক্রবারের হাসিমুখ দেখে আমিও মেনে নিতাম! আর ওকে দেখে দেখে, আমার ভেতর কবে যে, নীল বাসে একটা সিট, সরকারি হলে একটা রুম আর প্রিয় বিষয় নিয়ে স্বপ্নের চারা গজিয়ে উঠেছিল টেরই পাইনি!

দুই বছর পর, বড়াপুর মতো আমারও স্বপ্নপূরণ হয়ে গেল! সেই সবুজ ক্যাম্পাস, নীল বাস, হল রুম! আপু ততদিনে ভার্সিটির বেশ সিনিয়র! তখন আমি বেশ খুশি! এবার গঙ্গাফড়িং আর আমি একসাথে কাছাকাছি! ভাই-বোন মিলে ক্যাম্পাস চষে বেড়িয়েছিলাম বেশ কিছুদিন! তারপর, সে বছরই হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো এসেছিল দিনটা! দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল আমাদের সাজানো গোছানো পরিবারটাকে।

আমাদের দুজনের সেমিস্টার ফাইনাল চলছিল সেবার। আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল বড়াপুর একদিন আগে। আপুর আরও একটা পরীক্ষা বাকি ছিল। ও আমাকে বলেছিল, বাড়ি চলে আসতে; পরীক্ষা শেষ করে পরদিন আসবে ও। আমি ওর কথামতো একদিন আগে বাড়িতে চলে আসি বন্ধুদের সাথে। বড়াপু থেকে যায় ক্যাম্পাসে। পরদিন পরীক্ষা দিয়ে, বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়ে নীল বাসে। সেদিন ওর আর বাড়ি ফেরা হয়নি!’

এটুক বলে আমি অনেকটা হাঁপিয়ে উঠলাম। টং দোকান থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে ডগডগ করে গিলে ফেললাম। জাহু আর মৌরীর চোখ-মুখের ভঙ্গিতে অজস্র প্রশ্ন! তবুও ওরা একেবারে চুপ। ওদের দিকে তাকিয়ে আমি আবার বলা শুরু করলাম।

‘আমি বিকেল থেকে বড়াপু আসার অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু আপু আসে না। নীল বাস আমাদের শহরে ফেরার সময় গড়িয়ে যায়, তবু বাস কিংবা আপু কারোরই দেখা নেই। আমার মনে অজানা আশঙ্কায় কু ডেকে ওঠে। চিন্তিত অবস্থায় বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন খোঁজ নিতে। সাথে আমিও বের হই। ভার্সিটিতে কল দিয়ে জানতে পারি, নীল বাস নির্দিষ্ট সময়েই ছেড়ে গেছে। ওরা আমাকে বলে, হয়তো গাড়িতে যান্ত্রিক কোনো সমস্যা হয়েছে, চলে আসবে গাড়ি; আমি যেন টেনশন না করি। অথচ ওদের কথায় মন সায় দেয় না আমার। আমি হন্যে হয়ে পুরো শহর খুঁজতে থাকি, একটা নীল বাস আর আমার গঙ্গাফড়িংকে। কিন্তু পাই না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়, অন্ধকার নামে, গঙ্গাফড়িং বাড়ি ফেরে না! আমি আর বাবা সারা শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে ক্লান্ত হই।

এক সময় বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আমি পরিচিত একটা সিএনজি ভাড়া করি। সিএনজিতে উঠে ভার্সিটির দিকে যাত্রা শুরু করি। শুক্লপক্ষের আবছা চাঁদের আলো কেটে কেটে সিএনজি এগোয়। শহর পেরিয়ে গ্রাম অংশে ঢোকার পর, রাস্তার আশেপাশে মোটামুটি নির্জন জায়গা। প্রায় কয়েক কিলোমিটার ধরে রাস্তার আশেপাশে কোনো বাড়ি-ঘর, দোকানপাট কিংবা লোকজন কিছুই নেই। এমন একটা জায়গায়, রাস্তার পাশে ছোটো একটা খোলা মাঠে দূর থেকে দেখি বড়ো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এগোলে, সিএনজির হেডলাইটের আলো পড়তেই নিশ্চিত হই, এটা সেই নীল বাস; যেটাতে করে আমার গঙ্গাফড়িং আসছিল। কাছাকাছি গিয়ে সিএনজি থেকে নামি! অদ্ভুত কিংবা ভয়ঙ্কর একটা অনুভূতি আমার শিরদাঁড়া বেঁয়ে নিচে নেমে যায়। আস্তে আস্তে এগোতে থাকি নীল বাসের দিকে!’

আরও পড়ুন: পৌষালি প্রেম | ইসরাত জাহান জান্নাত

এটুক বলে আবার আমার কণ্ঠস্বর আটকে আসে। গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে আছে! এই অনুভূতির কোনো নাম নেই! ইচ্ছে করে চিৎকার করে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠি। কিন্তু পারি না! জাহু আর মৌরী এবার মুখ খুলে! শঙ্কিত চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করে, ‘তারপর? তারপর কী হলো!’ আমাকে আবার শুরু করতে হয়!

‘দিনটা আমার জীবনে না আসলেও পারত! এর আগে যদি স্রষ্টা আমাকে তাঁর কাছে তুলে নিতেন!

নীল বাসের কাছে গিয়ে দেখি, বাইরে থেকে কাউকে দেখা যায় না, শূন্য পুরো! সিএনজির ড্রাইবারসহ লাইট নিয়ে বাসে উঠলাম! এরপর যা দেখলাম, তা দেখার চেয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা হয়তো আমার জন্য সহজ হতো! বাসের মাঝখানটায়, নীচে আমার গঙ্গাফড়িং নিথর পড়ে আছে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়। শূয়োরের বাচ্চারা বড়াপুকে শকুনের মতো খুটে খুটে খেয়ে মেরে ফেলেছে! বড়াপুর অর্ধনগ্ন রক্তাক্ত শরীরটা দেখে আমি আর বেশিক্ষণ গাড়ির ভেতর দাঁড়াতে পারলাম না! দৌড়ে নেমে গেলাম। শূয়োরের বাচ্চারা আমার গঙ্গাফড়িংয়ের সম্ভ্রম নিয়েছে তো নিয়েছেই, অন্তত খুনটা না করলেও পারত! শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল বড়াপুকে। পৃথিবীতে কত গ্যালন গ্যালন অক্সিজেন, অথচ বড়াপু একফোঁটা অক্সিজেনের জন্য কী তীব্র কষ্ট নিয়ে চলে গেল ধরণি ছেড়ে।

সেই ধর্ষক ড্রাইবার আর হেল্পার এখনো পলাতক। এখনো পাওয়া যায়নি তাদের। অনেকের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায় সেদিন এমনিতেই বাসে ছাত্র-ছাত্রী ছিল কম। তার ওপর বড়াপু নামত শহরে এসে, একদম শেষ স্টপেজে। বাস শহরে ঢুকার অনেক আগেই আপু বাদে পুরো গাড়ি খালি হয়ে যায়। সেই সুযোগটাই নিয়েছে শূয়োরগুলো। গাড়িটাকে আর শহরেই আনেনি!

এদিকে আদরের একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা বাবা সহ্য করতে পারলেন না। সেদিনই স্ট্রোক করে বসলেন। কয়েক দিন আইসিউতে থাকার পর, যেদিন পোস্টমর্টেম শেষে পুলিশ আপুর লাশ ফেরত দিলো, সেদিন বাবাও চলে গেলেন ওপারে। এই বয়সে কাঁধে দুই-দুটো লাশের ভার কীভাবে নিয়েছি আমি নিজেও জানি না। একদিকে বাবা, অন্যদিকে প্রিয় বোন; এক সাথে দুজনকে হারানোর মতো এমন দিন যেন আর কারও জীবনে না আসে!’

এবার আর আমার চোখ বাঁধ মানে না। শ্রাবণের ধারা নেমে আসে সবেগে। জাহু আর মৌরীও কাঁদছে। কাঁদলে পৃথিবীর সকল নারীদেরকেই বোধহয় মায়াবতী মনে হয়। জাহু আর মৌরীকেও এই মুহূর্তে দুটো বহমান নদীর মতো মায়াময় লাগছে। অথচ আমার দুঃস্বপ্নের মতো গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। এখনো বাকি আছে ঢের! গল্প বলছি মনে হয় আধঘণ্টা সময় ধরে। অথচ মনে হচ্ছে, অনন্ত কাল ধরে বলে যাচ্ছি, কথা ফুরোচ্ছে না, শব্দ থামছে না; সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে অসীমের দিকে।

চোখ মুছে আমি আবার বলতে শুরু করি।

‘বাবা আর বোনকে কেড়ে নিয়েও, তখনো দুর্ভাগ্য আমার পিছু ছাড়েনি। বাবা আর বড়াপুর শোকে পাথর হতে হতে মাও একদিন নিস্তেজ হয়ে গেলেন। কয়েকমাসের ব্যবধানে একে একে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। পৃথিবীতে সাড়ে সাতশো কোটি মানুষ, অথচ আমার কেউ নেই; কী ভীষণ একা আমি! একাকিত্বের চাপ সয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না। ঠিক করেছিলাম এই জীবনটা আর রাখব না। কিন্তু যখনই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে যাই, চোখের সামনে বড়াপু চলে আসে। ওর অবয়বটা বলে ওঠে, ‘যাস নে প্যাঁচা, থাক! তোকে বাঁচতে হবে। তোর মতো প্রতিদিনই কোনো না কোনো ভাই তার আদরের বোনকে হারায়! প্রতিদিনই কেউ না কেউ এতিম হয়। ওদের জন্য হলেও তোকে বাঁচতে হবে। পৃথিবীর সব বোনকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে হবে তোকে!’

আরও পড়ুন: এগারো টাকার জীবন | আবুল হাসনাত বাঁধন

আমি থমকে যাই। আর এগোতে পারি না। তারপর সিদ্ধান্ত নিই, আমি বাঁচব। একা একা বাঁচতে হবে আমাকে। আমার মতো আর কেউ যেন প্রিয় বোনকে না হারায়, আর কেউ যেন এতিম না হয়; অমন পৃথিবী বানানোর জন্য আমাকে বাঁচতে হবে।

সবকিছু ভুলে, সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমি ঢাকা পালিয়ে আসি। পালিয়ে আসি দুর্বিষহ অতীতকে পেছনে ফেলে। এক বুক অনুভূতি আর আবেগ নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সেটাকেও পেছনে রেখে আসি। বড়াপুহীন ক্যাম্পাসটাকে আমার ভীষণ অচেনা মনে হতো, অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়ে আসতো। যে নীল বাসের স্বপ্ন আমার আর বড়াপুর আকাশে আঁকিবুকি খেলত, সেই নীল বাসটাই বড়াপুকে কেড়ে নিলো আমার থেকে। ভার্সিটি, হল, বাস সবকিছুর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা চলে এসেছিল আমার। তাই এখানে চলে এলাম। নতুন জীবন শুরু করলাম ঢাকাতে। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর, পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধবহীন আমার জীবনে হঠাৎ বৈশাখী ঝড়ের মতো জাহু আসলো। আমিও সবকিছু ভুলে জাহুকে নিয়ে বাঁচতে শুরু করলাম, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। পরের কাহিনি তো সব তোমাদের জানা-ই আছে!’

পাঁচ.

জাহু আর মৌরী পুরোটা শোনার পর অনেক্ষণ চুপ করে থাকল। আমিও চুপ করে থাকলাম। আকাশে মেঘ সরে গিয়ে সূর্য ওঠেছিল। সূর্যটা আস্তে আস্তে পশ্চিমে হেলে যাচ্ছে। সোনালি রোদের আভা এসে পড়ছে ওদের দুজনের মুখে। মনে হচ্ছে স্বর্গ থেকে দুজন দেবী মর্ত্যে এসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর মৌরী বলে ওঠল, ‘কিন্তু দাদা, আপনার বড়াপু আর আমার চেহারায় এত মিল কেন?’

উত্তরে আমি বললাম, ‘জানি না রে, এই প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেও খুঁজে পাইনি। তবে কোথায় জানি একটা প্রবাদ শুনেছিলাম- পৃথিবীতে একই চেহারার সাত জন ব্যক্তি থাকে। কে জানে, হয়তো প্রবাদটাই সত্য!’

মৌরী আবার বলল, ‘হয়তো…! আমি অরপ্যান হাউজে বড়ো হয়েছি। কে বা কারা আমাকে সেখানে রেখে গেছে, আজও জানি না। সাত দিন বয়েসী শিশুর কি কিছু জানার কথা? আমার মা-বাবা কারা, কোথায় তারা? আমার নাম কী, ধর্ম কী? কিছুই জানি না আমি। অরপ্যান হাউজের শ্যামলী ম্যাম আমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন। আমার অদ্ভুত নামটাও তাঁর দেওয়া। তাঁর দয়াতেই আমি আজ এতদূর আসতে পেরেছি। কিছুদিন আগে শ্যামলী ম্যামও আমাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন! প্রিয় মানুষগুলো আমাদের কাছে বেশি দিন থাকে না! আমিও এই পৃথিবীতে আপনার মতো খুব একা, দাদা। আমারও কোথাও কেউ নেই!’

জাহু তার দুহাত দিয়ে আমার আর মৌরীর হাত ধরে। এরপর আস্তে করে বলে, ‘কে বলেছে তোমাদের কেউ নেই? আমি আছি না!’

আমি জাহুর চোখের সমুদ্রে তাকাই। ইচ্ছে হয় বলি, ‘তুমি তো আমার অলিন্দ-নিলয়ে মিশে গেছো জাহু। তুমি ছাড়া আমার শ্বাসকষ্টের কথা ওপরের উনি ছাড়া কেউ কি জানে!’ কিন্তু কথাটা ভেতরেই থেকে যায়, আর মুখ দিয়ে বের হয় না! মৌরী জাহুকে দুহাতে ঝাপটে ধরে বলে, ‘তোমাকে খুব ভালোবাসিরে, আপুনি!’ এরপর তিন জন আবার কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে যাই।

সাময়িক নীরবতা ভেঙে মৌরী বলে ওঠে, ‘দাদা, আপনার বড়াপু তো নেই! উনাকে আমরা চাইলেও আর ফেরাতে পারব না! আমাকে আপনার গঙ্গাফড়িং হিসেবে একটুখানি জায়গা দেওয়া যায় না?’

আমি আদ্র কণ্ঠে বললাম, ‘গঙ্গাফড়িং তো একজনই ছিল রে! কিন্তু আজ থেকে তুই আমার রক্তের বোন! আমার পুচকি টিঁয়েপাখি!’

মৌরী আমার কাঁধে মাথা রেখে বলে, ‘তাহলে আপনিও আজ থেকে আমার ভাইয়ানি! ভালোবাসি ভাইয়ানি!’

আমিও বলি, ‘আমিও ভালোবাসি, টিঁয়েপাখি!’

আরও পড়ুন: তিথীর মৃত্যু | আরোহী হাসান

ছয়.

জাহু আঙুলের ডগা দিয়ে চোখ মুছে। তারপর বলে, ‘ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। আমাদের মনে হয় ওঠা উচিত, রফু!’

আমি এবার বললাম, ‘একটু দাঁড়াও, আমার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বাকি আছে!’

ওরা দুজনেই অবাক হয়ে বলল, ‘আরও কথা বাকি! আচ্ছা বলো…।’

আমি কণ্ঠস্বর কিছুটা নিচে নামিয়ে বলি, ‘কিছুদিন আগে অজ্ঞাত কারণে রক্ত কোষ ভেঙে গিয়ে দুটো ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে খুব হইচই পড়েছিল! ওই অদ্ভুত মৃত্যু দুটোর খবর দেখেছিল?’

জাহু বলে, ‘দেখব না কেন! ওই খবর তো সারা দেশের মানুষ জানে! কিন্তু ওসব এখন কেন বলছো, কিছুই তো বুঝছি না!’

‘ওই মৃত্যুগুলোর কারণ আমি ছাড়া কেউ জানে না!’

‘মানে?’

‘মানে হলো, ওই রহস্যজনক মৃত্যু দুটোর কারণ একমাত্র আমি জানি। কারণ ওদের আমিই মেরেছি!’

‘কী!! কী বলছো এসব উলটাপালটা! মাথায় কিছু ঢুকছে না!’

‘শোনো তাহলে…বাড়িতে আমাদের বেশ অনেকখানি জায়গা-জমি ছিল। ঢাকায় আসার আগে আমি ওগুলো সব বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বিক্রি করে আমার হাতে বেশ ভালো অঙ্কের টাকা আসে। ওই টাকা দিয়ে আমি মোটামুটি নির্জন একটা স্থানে কিছু জমি কিনে একটা বায়োটেক ল্যাব তৈরি করেছি। বিসিএল৩ ল্যাব। ওই ল্যাবে এখন তিন জন বায়োটেকনোলজিস্ট নিয়মিত গবেষণার কাজ করেন, তবে গোপনভাবে। সাথে আমিও থাকি। সাত-আট মাস আগে আমরা মানুষের রক্তকোষের মতো দেখতে একটা জিএম ভাইরাস তৈরি করেছিলাম।

ওই ভাইরাস পোষক দেহের বাইরে নিজে থেকে কিছু করতে পারে না। মানুষের শরীরে ম্যানুয়ালি ইনপুট করতে হয় ভাইরাসটাকে! পোষক দেহে ঢোকার পর ২৪ ঘণ্টা সময় নেয় এটা! এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে। সক্রিয় হয়ে আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে হোস্টের ব্লাড সেলে। ব্লাড সেলে ঢুকে নিজেদের লক্ষ লক্ষ প্রতিলিপি বানিয়ে নেয়। এরপর হোস্ট সেলকে ধ্বংস করে ফেলে। এটা আবার তাদের জন্য আত্মঘাতীও বটে। হোস্ট সেল মারা যাবার পর, ভাইরাস সেলগুলোও মরে যায়! আর সমস্ত ব্লাডসেল নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, ইনফেক্টেড পার্সন কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। এবার বুঝতে পেরেছো ব্যাপারটা— লোকগুলো কেমনে মারা গেল?’

জাহু আর মৌরী ভিনগ্রহের অ্যালিয়েন দেখেছে মতো করে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল আমার দিকে। তারপর জাহু বলল, ‘এসব বুঝেছি, কিন্তু বাকিটা মেলাতে পারছি না! কেমনে কী!’

আরও পড়ুন: এটা তো ছবির মতন | আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের

ওরা দুজন হয়তো আমাকে সাইকো ভাবছে। ওদের অদ্ভুত চাহনিতেই বুঝা যাচ্ছে সেটা। আমি এতটা ভাবলেশহীনভাবে নিজের সম্পাদিত অপরাধের কথা কীভাবে বলেছি; সেটা সম্ভবত মেলাতে পারছে না। আমি আর লুকোচুরি না করে বাকিটাও খোলাসা করলাম ওদের কাছে।

‘ওই শূয়োর দুটোকে মেরে আমি গঙ্গাফড়িংয়ের আত্মাকে কিছুটা শান্তি দিয়েছি। শালারা দুজনই ধর্ষণ কেসের আসামি। কয়েক মাস আগে একা পেয়ে এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছিল। এই হীরক রাজার দেশে ওদের কোনো বিচার হয়নি। আমি আগে নিজে ব্যক্তিগতভাবে কেসটা ঘেঁটেঘুঁটে দেখেছি। এরপর নিশ্চিত হলাম এরা সত্যিই ধর্ষক। তখন থেকে সুযোগ খুঁজতে শুরু করলাম ভাইরাস ইনপুট করার জন্য। ওদের ডায়াবেটিস রোগ আমার জন্য কাজটা সহজ করে দিয়েছে। প্রায় ইনসুলিন নিতে হতো ওদের; এটাকেই কাজে লাগিয়েছি! বড়াপুর ধর্ষকদের তো আর খুঁজে পাইনি, হয়তো পাব একদিন; কিন্তু আমার চোখের সামনে কোনো ধর্ষককে বেঁচে থাকতে দেবো না। এখন থেকে আমার একটাই লক্ষ্য ধর্ষকদের ধরে ধরে প্রাপ্য শাস্তি দেওয়া। আমার মতো আর কোনো ভাইকে যেন প্রিয় বোনকে হারাতে না হয়, এতিম হতে না হয়!’

জাহুর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেছে এবার। মুখে একটা চাপা উত্তেজনার মতো ভাব নিয়ে ও বলল, ‘এবার বুঝতে পেরেছি পুরো কাহিনি! কিন্তু রফু, তোমার কিছু হয়ে গেল? তুমি যদি ধরা পড়ে যাও; তাহলে তো তোমার ফাঁসি হয়ে যাবে।’

আমি জাহুকে আশ্বস্ত করলাম, ‘সে সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ ভাইরাসটা মানুষের রক্তকোষের আদলে গড়া। আবার হোস্ট সেলকে ধ্বংস করে নিজেও ধ্বংস হয়ে যায়। তাই কেউ ভিকটিমের এই মৃত্যুর কারণ কোনোভাবেই সনাক্ত করতে পারে না আর ডেড বডিতে সাসপেক্টিভ ক্লু হিসেবেও কিছু পায় না। ভাইরাস ও রক্তকোষের বৈসাদৃশ্য ধরতে পারার জন্য অনেক অ্যাডভান্সড ল্যাব দরকার! বাংলাদেশে ওই ধরনের ল্যাব তৈরি হতে আরও একশো বছর বাকি!’

অনেক্ষণ পর মৌরী এবার মুখ খুলল, ‘কিন্তু ভাইয়ানি, এই ভাইরাস যদি মিউটেটেড হয়ে সংক্রামক হয়ে যায়? হিউম্যান টু হিউম্যান সংক্রামিত হতে পারলে তো সারাদেশে পিঁপড়ার মতো লাশ পড়বে!’

আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, ‘এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ০.১% এরও কম। কারণ ভাইরাসটাকে আমরা এমনভাবে ডিজাইন করেছি যাতে এ ধরনের কিছু না হয়। এই ভাইরাস হোস্ট সেল মানে মানুষের রক্তকোষ বাদে অন্য সবখানে মৃতের মতো থাকে, জীবিতের মতো আচরণ করতে পারে না! এমন কি অন্য প্রাণীর শরীরেও মৃত হিসেবে থাকে, সক্রিয় হতে পারে না। তবে প্রকৃতির খেয়ালিপনা বুঝার সাধ্য আমাদের কারও নেই, তাই ০.১% “কিন্তু” থেকেই যায়! তাই তোর এই আশঙ্কার কথা আমরা আগেই ভেবে রেখেছি। এই ভাইরাসের জন্য ইতিমধ্যেই তিনটা ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে; আরও দুটো নিয়ে গবেষণা চলছে। ভাইরাস ইনপুট করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া হলে ভিকটিম বেঁচে যাবে। বুঝেছিস এবার?’

‘দারুণ! এবার বুঝতে পেরেছি। আমাকে আপনার টিমে নেবেন, ভাইয়ানি? আমিও শূয়োর মারার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই!’

মৌরীর কথা শুনে জাহু কপিলার ডায়লগ প্যারোডি করে বলল, ‘মাঝি, আমারেও নিবা না?’

আমি বললাম, ‘অবশ্যই, কেন নয়! আজ থেকেই তোমরা আমার সহযাত্রী। তবে আমাদের খুব সাবধানতার সাথে কাজ করতে হবে।’

আরও পড়ুন: অগল্প আগল্প ইগল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন

সাত.

আমার এবার নিজেকে কিছুটা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে পেজো তুলোর মতো মেঘ হয়ে ওড়ছি আমি। সবাইকে হারানো, একা, নিঃস্ব— আমি আজ দুজন ব্যক্তিগত মানুষকে খুঁজে পেলাম। জীবনের বাকি দিনগুলো আমাকে যাদের জন্য বাঁচতে হবে, যারা আমার বাকি পথটুকু চলার সহযাত্রী। নিজেকে কিছুটা ভাগ্যবানও মনে হচ্ছে— বোন আর প্রিয়তমা, দুজনকে একসাথে ফিরে পেয়ে!

শাহাবাগে চার রাস্তার মোড়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে। টুপ করে আঁধার নেমে আসলেও, কর্পোরেটের আলোয় বুঝা যাবে না সেসব। এখানে সন্ধ্যের পর মানুষের ভিড় আর ব্যস্ততা দুটোই বেড়ে যায়। তার আগেই আমাদের ফিরতে হবে। বাসের জন্য হাঁটা শুরু করলাম। দুপাশে দুটো হাত আমার দুহাতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। এই হাত দুটোকে আমি আর কখনো ছাড়ব না, এই হাতগুলোয় কখনো কোনো শূয়োরের আঁচড় লাগতে দেবো না, প্রয়োজনে ১০১ টা খুনের আসামি হতে হলে— হব!

এসব কথা কি ওপারের উনি ছাড়া আর কেউ জানে? জানলে জানুক, তাতে আমার কী!

-স মা প্ত-

 

স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প | © আবুল হাসনাত বাঁধন 


(১৫/০৫/২০১৯ – ২৫/০৯/২০২১)

[বরিশাল টাওয়ার, যাত্রাবাড়ি, ঢাকা; রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, ঢাকা; এবং পটিয়া, চট্টগ্রাম]

উৎসর্গ: ২২ তম জন্মদিনে প্রিয় তরুকে [ইসরাত জাহান জান্নাত]!

কীওয়ার্ডস: [ স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প – আবুল হাসনাত বাঁধন , স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প, আবুল হাসনাত বাঁধন , স্বপ্নভূক বিহঙ্গম কিংবা কিছু বিষাদের গল্প | আবুল হাসনাত বাঁধন , গল্পীয়ান , সায়েন্স ফিকশন , কল্পবিজ্ঞান , ফিকশন , রহস্য গল্প , রোমান্টিক গল্প , প্রেমের গল্প , ছোটোগল্প , থ্রিলার ]

লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন:

মন্তব্য করুন: