দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক দিন:
মফিজ তার রুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। ৫ ফিট বাই ৮ ফিটের ছোট্ট একটা রুম। এতে চিকন একটা খাট আর ছোট একটা টেবিল ঠাঁই পেয়েছে শুধু। জোহরের নামাজ পড়িয়ে এসে এখানে বিশ্রাম নেন ইমাম মাওলানা মফিজুর রহমান আনসারি। মেইন রোডের এক পাশে তিন তলা মসজিদ। তার পাশেই ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের থাকার জন্য সারি বেঁধে তিনটে রুম।
মফিজের জন্য হোটেল থেকে দুপুরের খাবার আসে। সেটা খেয়ে তিনি আসরের নামাজের আগ পর্যন্ত রুমেই শুয়ে থাকেন। খাবার দিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর খাওয়ার রুচি নেই। মাথায় যখন কঠিন চিন্তা ভর করে তখন খাওয়ার কথা ভুলে যান তিনি।
এখন তাঁর চিন্তার বিষয় হচ্ছে- বোন মোমেনা। মোমেনার স্বামী বাদল তার গায়ে হাত তুলেছে। কথাটা জানার পর থেকে মফিজের রাগে মাথা, হাত-পা সব জ্বলছে। যে বোনকে মা-বাবাসহ তিনি নিজেও সব সময় মাথার ওপর তুলে রাখতেন, কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেননি, সেই বোন পরের ছেলের হাতে মার খেলো! এই কথাটা তাঁর পেটে কিছুতেই হজম হতে চাইছে না।
কিন্তু তিনি বাদলকে কীভাবে শিক্ষা দেবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। বাদল আইনের লোক। ক্ষমতা আছে। সাধারণ কেউ হলে হুমকি-ধমকি দিয়ে কিছুটা সোজা করা যেত। কিন্তু বাদলকে হুমকি দেবে কী! সে নিজেই তো সবাইকে ধমকের ওপর রাখে।
গভীর চিন্তায় তিনি আচ্ছাদিত। ঠিক সেই মুহূর্তে রিং টোনের কর্কশ শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়ল তাঁর। বিরক্ত হয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে নামটা দেখেই সোজা হয়ে বসলেন। বাদল ফোন করেছে! কী বলবেন, কীভাবে বলবেন দ্রুত ঠিক করে নিলেন। রিসিভ করেই কৃত্রিম কঠোর সুরে বললেন, ‘বাদল সাব কী জইন্য ফোন করসো?’
বাদল বোধহয় মফিজের হাবভাব বুঝতে পারেনি। তাহলে তার বিমর্ষ কণ্ঠ শোনা যেত না, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাইজান। কেমন আছেন?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী খবর?’
‘ভাইজান, মোমেনা কি আপনার বাসায় গেসে? বাসায় তালা মারা। কোথায় গেসে আমারে বলে যায় নাই।’
মফিজ যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, সাথে সাথেই বললেন, ‘মেরে-ধরে ঘর থেকে বের করে দিসো, আমার বাসায় না এসে কোথায় যাইব?’
বাদল হাঁ হয়ে গেছে কথাটা শুনে। সে কীভাবে মোমেনাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারে সেটাই মাথায় আসছে না। তালাবদ্ধ থাকার কারণে সে নিজেই তো ঘরে ঢুকতে পারেনি। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল তার, আগেরদিন রাতে কথা কাটাকাটি হওয়াতে একটা চড় দিয়েছিল। তাও খুব হালকাভাবে। বাব্বা! এই মহিলা তো খুব চালু। এই সামান্য বিষয়টার জের ধরে ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠেছে! ভাইকে সত্য-মিথ্যা কি-না-কি বুঝিয়েছে কে জানে!
তার নীরবতার সুযোগ নিয়ে মফিজ বলে যেতে লাগলেন, ‘তুমি আইনের মানুষ হয়েও যদি বউকে মাইরধর করো… তাইলে সাধারণ মানুষ কী করবে? তারা তো আরও বেশি সুযোগ পাবে। তোমার থেকে এইটা আশা করি নাই মিঞা। এখন আমি মোমেনাকে তোমার কাছে ক্যামনে পাঠাই বলো। ছেলেমেয়ে একটারেও আনে নাই। ওদের কথা ভেবে দেখসো? ওরাও তো মাকে ছাড়া কষ্ট পাবে।’
ছেলেমেয়ের কথায় এতক্ষণ পর বাদলের মুখ থেকে স্বর বের হলো, ‘বেয়াদবি নেবেন না ভাইজান, বাচ্চাদের চিন্তা থাকলে তাদেরকে ফেলে যাইতো না আপনার বোন। কাউকে কিছু না বলে, বাসায় তালা মেরে চলে গেছে। স্কুল থেকে এসে ওরা কোথায় যাবে? খাবে কী? মানুষের বাসায় বাসায় ঘুরবে! লিজাকে দেখলাম একটা ছেলের সাথে ঢলাঢলি করতেসে। লজ্জায় আমার মরে যাইতে ইচ্ছা করতেসে ভাইজান।’
রাগের সাথে সাথে মফিজের যেন সাহসও বাড়ছে। এবারও তিনি বাদলের কথায় পাত্তা দিলেন না। উল্টো বললেন, ‘আমার বোনের কোনো দোষ নাই। সব তোমার দোষ। ঘরে বউ আর চারটা বাচ্চা রেখে আরেকটা বিয়া করসো। আরে, তোমার বড় মেয়েটারই তো বিয়ার বয়স হইসে। ভালো ঘরে বিয়া দিতে পারবা কিনা চিন্তা করসো কখনো?’
‘সেইটা আমার বিষয়। আপনার বোনের মতো মেয়ের কপালে যদি আমার মতো জামাই থাকে, লিজার কপাল খারাপ হবে কেন? সেও কোনো সাদাসিধা ভালো ছেলের সর্বনাশ করবে আরকি।’
মফিজ হঠাৎ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। বাদল তো একটা মিচকা শয়তান। কীসের মধ্যে কী কথা এনে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে! রাগে অপমানে কাঁপতে থাকেন মফিজ। চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘শুয়োরের বাচ্চা, তুই নিজে এসে মোমেনার কাছে মাফ চেয়ে ওরে সসম্মানে নিয়া যাবি। নইলে তোরে আমি দেখে নেবো। কী মনে করছস আমাকে?’
‘অসম্ভব ভাইজান। আপনি আমাকে মাফ করেন, আমি মোমেনাকে আনতে যাইতে পারব না। সে নিজে গেছে, নিজেই যেন চলে আসে, বেলা ডোবার আগে। রাখি, ভালো থাকেন।’
মফিজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয় বাদল। মুখের ওপর বলে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু মোমেনা যেমন ঘাড়ত্যাড়া; তার ভাই আরও বড় ঘাড়ত্যাড়া। এত সহজে ছাড় দেবে না।
হয়তো ভাইয়ের বাসায় থেকে যাবে কয়েক দিন। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাদল যখন নিজেই বিপাকে পড়বে তখন আনতে যাবে, এরকম পরিকল্পনা করতে পারে তারা। যাই হোক, মোমেনার বেপরোয়া চালচলন অনেক সহ্য করেছে বাদল। আর না! এবার কিছু একটা হতেই হবে, এসপার নয় ওসপার। কিন্তু এখন আপাতত বাচ্চাগুলোর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তিন মেয়ে ওএক ছেলে, বাদল-মোমেনার। লিজা কলেজে পড়ে। বাকিরা স্কুলে। বিকেল চারটায় স্কুল ছুটি হবে। কী করা যায় এখন? সবাইকে নিয়ে ছোট বউয়ের কাছে যাবে? নাকি নিজের বাসার তালা ভাঙবে?
ওদিকে ফোন কেটে যাওয়ার পরও মফিজ অনেক্ষণ যাবত শান্ত হতে পারেন না। মনে মনে কঠিন পণ করেন, বাদলকে চরম শাস্তি দেবেন তিনি। কিন্তু বাদলের তুলনায় তার সামর্থ্য কিছুই না বলতে গেলে। তার সাথে জিততে হলে বুদ্ধির প্রয়োগ করতে হবে। তাই মফিজ তার কুবুদ্ধিতে চ্যাম্পিয়ন বন্ধু তাহের নূরীকে ফোন করেন। রাতে বাসায় দাওয়াত দেন। মোমেনার সামনে তখনই খোলাখুলি কথা বলবেন।
তাহের নূরীর সাথে কথা বলে খুশি মনেই খেতে বসেন তিনি। ঠান্ডা হয়ে আসা মিক্সড সবজি, ডাল আর সিদ্ধ ডিম দিয়ে ঠান্ডা ভাত খেতে তাঁর তেমন খারাপ লাগছে না। কিন্তু আছিয়া খাতুন যদি এমন ঠান্ডা খাবার দিত তাহলে সাথে সাথে প্লেট ছুঁড়ে মারতেন তিনি। বাইরে অবশ্য ভিন্ন কথা। ঘরের ঘরনিকে সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। নাহলে ঘর আর বাইরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়! এটা মাওলানা মফিজুর রহমান আনসারির ব্যক্তিগত মতামত!
(চলবে)
[কীওয়ার্ডস:
অবিচার [ চতুর্থ পর্ব ] | সালসাবিলা নকি
অবিচার [ চতুর্থ পর্ব ] : সালসাবিলা নকি
অবিচার [ চতুর্থ পর্ব ] – সালসাবিলা নকি
ছোটোগল্প | অবিচার [চতুর্থ পর্ব]
সালসাবিলা নকির ছোটোগল্প | অবিচার [চতুর্থ পর্ব]
ছোটোগল্প , সমকালীন গল্প , জীবনধর্মী গল্প, নন-ফিকশন , গল্পীয়ান]